বৃহস্পতিবার, ১৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১লা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৪ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার, ১৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১লা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৪ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

জামায়াতের রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব: জনপ্রিয়তার কৌশল ও বাস্তবতা

দীপ্ত নিউজ ডেস্ক
21 minutes read

মাসউদ বিন আব্দুর রাজ্জাক

বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচিত বিষয় রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতের সংস্কার। খাতভিত্তিক সংস্কারের এ আলোচনা নতুন নয়। অতীতেও রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এলে বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেবে বলে জনগণকে আশ্বাস দিয়েছিল, কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে খাতগুলো মোটাদাগে জরাজীর্ণই থেকে গেছে; হয়নি কাঙ্ক্ষিত সংস্কার।

ছাত্রজনতার ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে গণদাবিতে পরিণত হয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার। এমন বাস্তবতায় ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বধীন সরকার।

সরকারের সংস্কারের এ উদ্যোগের ভালোমন্দ পর্যালোচনা এবং নতুন নতুন সংস্কারের প্রস্তাব দিচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠনগুলো। সভাসেমিনার করে সংস্কার প্রস্তাবগুলো তুলে ধরছে তারা। নাগরিক সমাজের বাকি অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা ব্যক্তিগত নানা পরিসরে সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করছে।

অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের সঙ্গে কয়েক দফার সংলাপ, আলোচনা, সভাসমাবেশের মাধ্যমে অনেক বিষয়ে সংস্কারের প্রস্তাব/দাবি জানিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপি গত বছরের জুলাইয়ে ঘোষিত ৩১ দফা রূপরেখাকেই সংস্কার প্রস্তাব হিসেবে দাবি করে আসছে, তবে রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে।

রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে বুধবার এক অনুষ্ঠানে জামায়াত নিজস্ব সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করে। দলটির আমির ডা. মুহাম্মদ শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে বিচার বিভাগ, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, নির্বাচন ব্যবস্থা, সংসদ, শিক্ষা ও সংস্কৃতিসহ রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান খাতে সংস্কারের প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।

প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী বিষয় উঠে এসেছে। বিশেষ করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন ও শিক্ষার মানোন্নয়নের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য জরুরি, তবে প্রস্তাবগুলোতে কিছু দুর্বলতা ও অস্পষ্টতা পরিলক্ষিত হয়েছে।

এখানে দুটি প্রশ্ন করা দরকার মনে করছি। প্রথমত, প্রস্তাবগুলো কি বাস্তবায়নযোগ্য? দ্বিতীয়ত, বর্তমান কাঠামোর সঙ্গে প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ?

এবার আসি খাতভিত্তিক সুনির্দিষ্ট আলোচনায়। জামায়াত তাদের প্রস্তাবে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগ ও ব্যবস্থার সংস্কার চেয়েছে। সেসব সংস্কার কতটা স্পষ্ট ও বাস্তবসম্মত, তাই আমার আলোচনার মূল উদ্দেশ্য।

. বিচার বিভাগ: প্রস্তাবে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে, যা ন্যায়বিচারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এ নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রস্তাবে সুস্পষ্ট রূপরেখা নেই। কীভাবে এ নীতিমালা প্রণয়ন এবং কার্যকর হবে বা এর ওপর কে নজরদারি করবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা দেয়া হয়নি। প্রস্তাবে বিচার বিভাগের দ্বৈত শাসন দূর করার কথা বলা হয়েছে, তবে এটি কীভাবে কার্যকর হবে এবং কোন কাঠামোর মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন হবে, তা স্পষ্ট নয়।

আলাদা সচিবালয় করার প্রস্তাবটি অনেকের কাছে সময়োপযোগী মনে হতে পারে। ন্যায়বিচার নিশ্চিতে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখা উচিত, কিন্তু আলাদা সচিবালয় হলে প্রকৃত স্বাধীনতার পথ সুগম হবে নাকি রাষ্ট্রের ব্যয় বাড়বে, সে প্রশ্ন থেকে যায়।

. সংসদীয় সংস্কার: বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার মনোনয়ন এবং ছায়া মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব নাগরিকদের উল্লেখযোগ্য অংশের কাছে নতুন ধারণা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, তবে এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ করার অবকাশ রয়েছে। বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ছায়া মন্ত্রিসভা কি বাস্তবায়নযোগ্য? বিরোধীদলীয় নেতার হাতে কার্যকর ক্ষমতা দেওয়া হলে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমন্বয় বাড়বে নাকি আরও জটিলতা সৃষ্টি হবে?

. নির্বাচন ব্যবস্থা: প্রস্তাবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এটি কার্যকর করার পদ্ধতি ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা নিয়ে বিশদ আলোচনা নেই। দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ পদ্ধতি কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিরোধিতা করা হয়েছে, যা অনেক দেশের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও গোপনীয়তার একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। তাহলে কেন আমাদের দেশে এটি বাতিল করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল?

প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের কথা বলা হয়েছে, যা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক আছে। দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সংকটের কারণে অনেকের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গ্রহণযোগ্যতা আছে। প্রশ্ন হলো দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাসের কারণে এ ধরনের সরকার সত্যিই সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করবে নাকি প্রত্যেকবার নতুন নতুন সংকটের জন্ম দেবে?

. আইনশৃঙ্খলা বাহিনী: পুলিশ বাহিনী সংস্কারের প্রস্তাবগুলোর মধ্যে স্বতন্ত্র পুলিশ কমিশন গঠন ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রোধের কথা বলা হয়েছে, তবে এটি কার্যকর করার পদ্ধতি কীভাবে প্রণয়ন করা হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আলোচনা নেই। পুলিশের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে দলীয় প্রভাব বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এ প্রস্তাব কতটা কার্যকর হবে? ক্ষমতাসীন দলের সহযোগিতা কি আদৌ পাওয়া যাবে?

পুলিশের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব এসেছে। ধর্ম একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় এবং এর শিক্ষা সাধারণত মানুষ পরিবার ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রহণ করে। তাই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পুলিশ বাহিনীতে ধর্মীয় শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি গভীর সংকট সৃষ্টি করতে পারে। এতে পুলিশের আচরণে পক্ষপাতিত্ব বাড়তে পারে, যা তাদের পেশাদারত্ব ও আইনের শাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অনুভূতির অপব্যবহার করার সুযোগ তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া সমাজের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন জরুরি, যাতে করে আইনের শাসন সুসংহত হওয়ার পাশাপাশি জনগণের প্রতি পুলিশের আস্থা বৃদ্ধি পায়।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) সংস্কারের প্রস্তাব সময়োপযোগী বিবেচিত হতে পারে, তবে র‌্যাবের কার্যক্রম মনিটরিং সেলের মাধ্যমে কীভাবে এর কার্যকারিতা পরিমাপ করা হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য নেই প্রস্তাবে।

. শিক্ষা ও সংস্কৃতি: শিক্ষা সংস্কারে পাঠ্যপুস্তক থেকে ধর্মীয় মূল্যবোধবিরোধী উপাদান বাদ দেয়ার প্রস্তাব এসেছে, কিন্তু প্রশ্ন হলো ধর্মীয় মূল্যবোধবিরোধী উপাদান কীভাবে নির্ধারণ করা হবে? শিক্ষাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নিরীক্ষা করার ফলে কি শিক্ষার আধুনিকায়ন বাধাগ্রস্ত হবে না? সাধারণ শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা ব্যবস্থাকে মাদ্রাসা শিক্ষার দিকে বেশি ঝুঁকিয়ে দেয়ার প্রস্তাব সার্বিক উন্নয়নের জন্য কতটা সঠিক? মাদ্রাসা শিক্ষা প্রসারের প্রস্তাব ধর্মীয় শিক্ষার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা সৃষ্টি করতে পারে, যা সাধারণ শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

. প্রশাসনিক সংস্কার: জনপ্রশাসনে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে দুর্নীতি রোধের প্রস্তাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু প্রশ্ন হলো এ দুর্নীতির শিকড় উপড়ে ফেলা সম্ভব কীভাবে? দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু আমাদের দেশে কি সত্যিই এমন একটি শক্তিশালী সংস্থা গড়ে তোলার সক্ষমতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা রয়েছে?

সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো জামায়াত তাদের প্রস্তাবে ‘বিতর্কিত সকল বই বাতিল ও প্রকাশনা বন্ধ করা’র দাবি জানিয়েছে। এটি মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের শামিল। এতে সমাজের যেকোনো ভিন্নমতকে দমন করা সহজ হবে, যা মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার বিকাশে বাধার সৃষ্টি করবে।

একটি গণতান্ত্রিক সমাজে বিভিন্ন মত ও বিশ্বাসের সহাবস্থান থাকা জরুরি। তা ছাড়া বিতর্কিত বই কীভাবে নির্ধারণ করা হবে, তার সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড কী, এ প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর প্রস্তাবে নেই। একটি বই বা লেখা কার কাছে বিতর্কিত মনে হবে, তার সিদ্ধান্ত কে নেবে? একজনের কাছে যা বিতর্কিত, অন্যজনের কাছে তা গুরুত্বপূর্ণ ও জ্ঞানগর্ভ হতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, রাষ্ট্র সংস্কারে জামায়াতে ইসলামী যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, তার মধ্যে অনেকগুলোকে সময়োপযোগী বিবেচিত হতে পারে, তবে এগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। প্রস্তাবগুলো শুধুই রাজনৈতিক জনপ্রিয়তার জন্য নাকি সত্যিই দেশের কাঠামোগত উন্নয়নের জন্য কার্যকর ভূমিকা পালন করবে, তা নিয়ে ভাবার অবকাশ আছে। সংস্কারের মাধ্যমে যে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে, বাস্তবে তা আমাদের উন্নতির পথে নিয়ে যাবে কি না, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা স্পষ্ট হবে।

লেখক: নিউজ এডিটর ও অনলাইন ইনচার্জ, দীপ্ত টেলিভিশন

আরও পড়ুন

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More

সম্পাদক: এস এম আকাশ

স্বত্ব © ২০২৩ কাজী মিডিয়া লিমিটেড

Designed and Developed by Nusratech Pte Ltd.