প্রতিনিয়ত সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিবর্তন হচ্ছে চাকরির বাজার, সেই সঙ্গে বদলাচ্ছে বাজারের চাহিদাগুলো। লবিং ও রেফারেন্সের মতো চিরাচরিত বিষয়গুলো প্রায়ই প্রার্থীদের মৌলিক দক্ষতা ও যোগ্যতাকে ছাপিয়ে যায়। এই বিড়ম্বনাগুলোকে পাশ কাটানোর জন্য দক্ষতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়া উচিৎ।
চলুন, চাকুরি পেতে রেফারেন্স বা লবিংয়ের বিকল্প হতে পারে এমন কিছু অপরিহার্য দক্ষতার ব্যাপারে জেনে নেওয়া যাক।
যে দক্ষতাগুলো চাকরি পেতে লবিং বা রেফারেন্সের বিকল্প হিসেবে কাজ করে–
১. ব্র্যান্ডিং– প্রতিযোগীদের ভিড়ে আলাদাভাবে নিজেকে প্রকাশ করার একটি মোক্ষম উপায় হচ্ছে সেল্ফ–ব্র্যান্ডিং। এটি একজন ব্যক্তির কাজ, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও অর্জনগুলো পরিবেশনের মাধ্যমে তার একটি স্বতন্ত্র পেশাদার পরিচয় তৈরি করে।
বর্তমানে অনলাইন যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে আরও কার্যকরভাবে ব্র্যান্ডিং করা যায়। একটি পেশাদার লিঙ্কডইন প্রোফাইল, একটি ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট বা পোর্টফোলিও বর্তমানে ডিজিটাল ব্র্যান্ডিংয়ের পরিচয় বহন করে। জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমগুলোর পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট ইন্ডাস্ট্রি কেন্দ্রিক ব্লগিং প্ল্যাটফর্ম ও ফোরামগুলোতে সক্রিয় থাকার মাধ্যমেও ব্র্যান্ডিং করা যায়।
২. যোগাযোগের দক্ষতা– শুধু কর্মক্ষেত্রেই নয়, জীবনের যে কোনো কাজের জন্য সঠিকভাবে যোগাযোগ করা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দক্ষতা। এটি মূলত মৌখিক ও লিখিত– দুইভাগে বিভিক্ত। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আচরণগত ভাষা মৌখিক যোগাযোগকে সহজে বোধগম্য করে তোলে। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ নামে পরিচিত এই ধরনটি মূলত দেহের অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে কোনো কিছু বোঝানোর চেষ্টা করে। হাত বা মাথা নাড়ানোর সঙ্গে মুখের কথার সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া জরুরি।
সাক্ষাৎকার, মিটিং বা আড্ডার সময় মৌখিক যোগাযোগের দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ। আর লিখিত যোগাযোগ সক্ষমতা কাজে লাগে ইমেইল, প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন পেশাদার নথির খসড়া তৈরির সময়। বলার সময় কথা ও লেখার সময় বাক্য যত স্পষ্ট ও সংক্ষিপ্ত হয় ততই তা শ্রোতা বা পাঠকের জন্য সহজ হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে সব ধরনের মানুষের বোঝার নিমিত্তে সার্বজনীনতা বজায় রাখা আবশ্যক।
৩. সমস্যা সমাধানের দক্ষতা– চাকরির সঙ্গে সম্পর্কিত সাধারণ দায়িত্বগুলোতে আলাদা মান যুক্ত হয় সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে। এই দক্ষতার মধ্যে রয়েছে সঠিক সমস্যাটি শনাক্ত করা, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তা বিশ্লেষণ করা এবং কার্যকর সমাধানটি বের করে সেই সমস্যাটির যেন পুনরাবৃত্তি না হয় তা নিশ্চিত করা।
নিয়োগকর্তারা এমন ব্যক্তিদের পছন্দ করেন, যারা অপ্রত্যাশিত সমস্যাগুলোর একটি সৃজনশীল সমাধান বের করতে পারে। এ ধরনের ব্যক্তিরা প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহের সময় তার খুটিনাটি পর্যবেক্ষণ করেন এবং সমাধানের ক্ষেত্রে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হন।
৪. যে কোনো পরিবেশে দ্রুত মানিয়ে নেওয়া– শুধুমাত্র নতুন চাকরিপ্রার্থীদের জন্য নয়, নতুন পরিবেশের সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নেওয়া অভিজ্ঞ লোকদের জন্যও জরুরি। কেননা প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি কর্মক্ষেত্রেই আসছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। প্রতিনিয়ত সামনে আসছে নতুন শর্ত, নতুন পদ্ধতি ও নতুন পরিস্থিতি, নতুন দায়িত্ব। এমন পরিবর্তনের ধাক্কা সামলাতে প্রায়ই প্রয়োজন হচ্ছে দ্রুততার সঙ্গে নতুন কিছু শিখে নেওয়া।
যারা নিজেদের আরামপ্রদ জায়গাটি একবার খুঁজে পাওয়ার পর সেখান থেকে আর বেরতে চান না, তারা এই অবস্থায় সমূহ বিড়ম্বনার শিকার হন। কারণ এক সময় যে কাজ বা দক্ষতাটি বেশ চাহিদা সম্পন্ন ছিল, কয়েক বছরের মধ্যে তার বাজার আর নাও থাকতে পারে। আর তাই ক্যারিয়ারের অগ্রগতির আরেক অর্থ হচ্ছে অভিযোজন ক্ষমতা।
৫. দলবদ্ধ হয়ে কাজ করার প্রবণতা– একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান মানেই অনেক লোকের সমাগম। একাধিক মানুষের কারবার থাকলে স্বাভাবিকভাবেই সেখানে ছোট–বড় দ্বন্দ্বের ব্যাপার থাকে। তাই এখানে দরকার হয় সমঝোতা, আপোস ও গঠনমূলক প্রতিক্রিয়ার। সহকর্মীদের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করা হলে লক্ষ্য অর্জন সহজ হয় ও সেই সঙ্গে কাজের প্রতি সন্তুষ্টিও থাকে।
৬. সময়ানুবর্তিতা– যে কোনো উৎপাদনশীলতাকে তার স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দিতে পারে সময়ানুবর্তিতা। প্রত্যেকটি কাজের জন্য ঠিক করতে হবে একটি নির্দিষ্ট সময়। অতঃপর সেই সময় অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই নির্দিষ্ট কাজটি করার ক্ষেত্রে বদ্ধ পরিকর থাকতে হবে। এভাবে প্রতিদিন নিজের সঙ্গে নিজেই প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া যেতে পারে। কাজের চাপের ক্ষেত্রে গুরুত্বের ভিত্তিতে কাজগুলোকে আগে–পরে সাজানো উচিৎ।
৭. মধ্যস্থতা বা আপোসের দক্ষতা– বিভিন্ন পেশাগত পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষের জন্য সুবিধাজনক ফলাফল অর্জনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আপোসের দক্ষতা। চাকরির ইন্টারভিউয়ে বেতন, নতুন বিনিয়োগ বা ঋণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত, কিংবা নানা ধরনের প্রকল্পের শর্তাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। এমনকি প্রতিটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মৌলিক কাজ তথা পণ্য বা সেবা বিক্রির জন্য এই দক্ষতা থাকার আবশ্যক।
৮. আত্মবিশ্বাস– এটি এমন এক মৌলিক বৈশিষ্ট্য যার অভাবে যথেষ্ট পারদর্শিতা থাকার পরেও নিমেষেই তা মূল্যহীন হয়ে যেতে পারে। একজন আত্মবিশ্বাসী ব্যক্তিদের নিজের কর্মক্ষমতার ব্যাপারে দৃঢ় ভাবে অবস্থান নিতে এবং তার কাজ সংক্রান্ত ব্যাপারে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত দিতে পারে। এতে করে যিনি কাজ দিচ্ছেন তিনি সেই ব্যক্তির উপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারেন।
যে কোনো জরুরি অবস্থায় এ ধরনের ব্যক্তিরা তার আশেপাশের লোকদের পরম নির্ভরতার খোরাক যোগান। একটি টিমে কোনো সদস্য যখন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন, তখন তার সহকর্মীরা লক্ষ্য অর্জনে নিশ্চয়তা বোধ করেন। এই মানসিকতা তাদের প্রত্যেকের দিক থেকে শতভাগ চেষ্টা করার ইন্ধন যোগায়।
৯. ডিজিটাল সাক্ষরতা– বর্তমানের প্রযুক্তি–নির্ভর কর্মক্ষেত্রে প্রতিটি বিভাগের জায়গা দখল করে নিচ্ছে ডিজিটাল ব্যবস্থা। প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সফ্টওয়্যার। মাইক্রোসফ্ট অফিস, গুগল ওয়ার্কস্পেস, হোয়াট্সঅ্যাপ এবং জুমের মতো অ্যাপ্লিকেশনগুলো চালানোর দক্ষতা কোনো চাকরি বিজ্ঞপ্তিতে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয় না। ধরেই নেওয়া হয় যে কম্পিউটার কিবোর্ড টাইপ করার মতো এই বিষয়গুলোতেও প্রার্থীর অভ্যস্ততা রয়েছে।
১০. পেশাদারিত্ব– ইন্ডাস্ট্রি ভেদে প্রতিটি কাজেরই রয়েছে কিছু নিজস্ব নীতিমালা। এই নিয়মগুলোর আঙ্গিকে একজন ব্যক্তি তার কাজের প্রতি কতটা নিবেদিত তা যাচাই করা হয়। যেমন প্রতিষ্ঠানগত আচরণপ্রথা, সময়ানুবর্তিতা, উপযুক্ত পোশাক, গোপনীয়তা ও ব্যক্তিগত আবেগের বশবর্তী হয়ে বিচার না করা। এগুলো কেবল কর্মজীবনের জন্য পৃথক কোনো বৈশিষ্ট্য নয়। বরং শিক্ষা জীবন থেকে একজন স্বশিক্ষিত ব্যক্তির মাঝে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এগুলোর আবির্ভাব ঘটে। এই গুণাবলী সহকর্মী এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্রুত সম্পর্ক তৈরিতে অপরিসীম ভূমিকা পালন করে।
এই দক্ষতাগুলোর সঠিক প্রদর্শনের মাধ্যমে লবিং বা রেফারেন্স নির্ভর চাকরির বাজারের দৃশ্যপটে অনেকটাই পরিবর্তন আনা যেতে পারে। বিশেষ করে ডিজিটাল সাক্ষরতার সঙ্গে অনলাইন মাধ্যমগুলোতে নিজের ব্র্যান্ডিং করাটা ইন্টারভিউয়ে ডাক পাওয়ার ক্ষেত্রে শতভাগ উপযোগী।