একদিন খুব ভোরে ‘দে–ছুট‘ ভ্রমণ সংঘ’র বাইক রাইড গ্রুপের বন্ধুরা ছুটলাম, ইতিহাস ঐতিহ্যের নগরী সোনারগাঁ উপজেলার পানাম নগর। পথে যাত্রাবাড়ি মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল ঘরের পাশে সবাই একত্রিত হলাম। মূলত মূল রাইড এখান থেকেই শুরু। পথে কাঁচপুর হতে এসিস্ট্যান্ট বেস্ট অর্গানাইজার আরাফাত হাসান আমাদের রিসিভ করি।

এক ফ্রেমে ‘দে-ছুট’র সদস্যরা। ছবি: দে ছুট
ছুটে চলেছে ‘দে–ছুট‘। মনের মাঝে এক অন্যরকম অনুভূতি। কারণ পাহাড়–পর্বত, বন–জঙ্গল, নদী–হাওর, জলাশয়–সাগর বহু দূর-দূরান্ত আর গহীন থেকে গহীনে প্রকৃতির নির্জাস নিতে ঘুরে বেড়াই। গিয়েছি দেশের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলের রাজবাড়ি, জমিদারবাড়ি ও ঐতিহাসিক স্থাপত্য দর্শনে। কিন্তু বাড়ির পাশের পানাম নগরে যেতে পারেনি। একেই বলে বাতির নিচে অন্ধকার।
সেজন্য দেশ দর্শনে অবিরাম ছুটে চলা; সেই সপ্তম শ্রেণির ছাত্রবস্থা হতে ঘোরাঘুরি শুরু, আজও মনে হয় প্রকৃতির দান আমার এই সুন্দর বাংলাদেশ এখনো যেনো কিছুই দেখা হয়নি।
ফ্লাইওভার হতে ঘন্টা খানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাই সোনারগাঁ লোক ও কারু শিল্প জাদুঘরের সদর ফটকে। পাশেই এক রেস্তোরায় রান্না হবে রনি আর কাইউম ভাইয়ের সৌজন্যে খিচুড়ি আর রাজহাঁস ভুনা। অ্যান্টারমেইন্ট অর্গানাইজার ফারুকের কাছে বাজার সদাই সব বুঝিয়ে দিয়ে, গেলাম অল্প দূরত্বের পানাম নগরে।
নগরের ভিতরে প্রবেশ করতেই চোখ ছানাবড়া। অনেকটা আমাদের আদি ঢাকার মত সুরু রাস্তা। ধীরগতিতে হাঁটতে থাকি। অধিকাংশ ভবনেই ঝুঁকিপূর্ণ লেখা– ‘সাবধান‘ বাণী। না লিখেই বা উপায় কি। সেই ১৫ শতকে বাংলার স্বাধীন শাসক ঈশা খাঁ সোনারগাঁ‘তে প্রথম বাংলার রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। প্রাচীন সোনারগাঁতে বড় নগর, খাস নগর ও পানাম নগর এই ৩ নগরের মধ্যে সবচাইতে আকর্ষণীয় ছিল পানাম নগর। প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছিল এই নগরী। যা এখন প্রায় বিলুপ্ত। যতটুকু আছে তাই দেখে এই প্রজম্ম ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ব স্থাপনা সম্পর্কে ধারণা নিতে পারে।

সোনারগাঁওয়ের ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠে পানাম নগর। ছবি: দে ছুট
২০০৬ সালে ওয়ালর্ড মনুমেন্ট ফান্ডের তৈরি বিশ্বের ধ্বংসপ্রায় ১০০টি ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকায় পানাম নগরী স্থান পায়। বাংলার বারো ভুঁইয়াদের মাঝে অন্যতম শাসক ঈশা খাঁর পদচারণাও ছিল এখানে। নগরীর পূর্ব দিকে রয়েছে মেঘনা নদী আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা। এই নদী পথেই পাশ্চাত্যে মসলিন রপ্তানি হত। নগরের রয়েছে বিশাল ফটক। সূর্যাস্তের পর পরই ফটক লাগিয়ে দেয়া হত যা এখনো। কোন দর্শনার্থী সূর্যাস্তের পর ভেতরে থাকতে পারে না।
পানাম নগরের দৃষ্টি নন্দন কারুকার্যময় বাড়িগুলোর অধিকাংশই এক ও দ্বিতল বিশিষ্ট। এখানে ছিল হিন্দু ধনী ব্যবসায়ীদের বসতি। তাদের ব্যবসা–বাণিজ্য কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মূলত তারাই গড়ে তুলে ছিল এই পানাম নগরী। বর্তমানে টিকে থাকা বাড়ির সংখ্যা ৫২টি। প্রতিটি বাড়ির নকশাই আকর্ষণীয় স্থাপত্যর প্রাচীন নিদর্শন। নগরের ভেতরে রয়েছে ৫টি পুকুর, প্রতিটি বাড়িতেই সূপেয় পানির জন্য ছিল কূপ। পানাম নগরে মসজিদ, মন্দির, বিচার ঘর, নাচ ঘর ইত্যাদিসহ রয়েছে প্রায় ৪০০ বছরের পুরোন টাকশাল বাড়ি। রয়েছে আরও অনেক সমৃদ্ধ ইতিহাস।
যা না লিখলেই নয়, পারস্যের খ্যাতিমান কবি হাফিজকে পানাম নগর বেড়ানোর আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তৎকালীন বাংলার সুলতান গিয়াসুদ্দিন আযম শাহ। কিন্তু বৃদ্ধ কবি আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েও আসতে না পারার কারণে, গজল রচনা করে উপহার পাঠান সুলতানকে। সেই গজলের সূত্র ধরেই ফর্সি এক পর্যটক আসেন সোনারগাঁ। তিনি পানাম নগরের সৌন্দর্য দেখে বেশ মুগ্ধ হন। যে মুগ্ধতার রেশ এখনও কাটেনি। এই প্রজম্মের দেশ–বিদেশের পর্যটকরাও পানাম নগরেরর প্রতি বেশ আকর্ষণ বোধ করেন।
এবার আমরা শওকত আজমের তথ্যমতে ছুটি গোয়ালদী। অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে যাই গোয়ালদী গায়েবী মসজিদ। সোনারগাঁতে অবস্থিত এটি একটি অন্যতম প্রাচীন মসজিদ। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে মোল্লা হিজবর খান ১৫১৯ খিস্টাব্দে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। এক গুম্বুজ বিশিষ্ট মসজিটির ভিতরে–বাহিরের দেয়ালে রয়েছে চমৎকার দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য। ১৯৭৫ সালে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর কিছু অংশ সংস্কার করে। এরপর সোনারগাঁর জনপ্রিয় ভোকাল সাহেদ আহম্মেদ হতে বিদায় নিয়ে চলে যাই লোক ও কারুশীল্প জাদুঘর। সেই গল্প আজ থাক, তুলে রাখলাম আগামী কোন এক সংখ্যার জন্য।
প্রবেশ ফিঃ– জনপ্রতি ২০/= টাকা। সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৯টা হতে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
লেখক: মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম
এসএ/দীপ্ত সংবাদ