অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলা ক্রমশই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। চলমান সংঘাতে প্রতিদিন শত শত মানুষের জীবন হারাচ্ছে, যার বেশিরভাগই নিরীহ সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে আবার সিংহভাগই নারী ও শিশু।
গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর হামলায় আরও ২৮৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এ সময়ে আহত হয়েছেন ৮১৪ জন। এতে করে উপত্যকাটিতে নিহতের মোট সংখ্যা ৩৭ হাজার ছাড়িয়েছে।
মূলত চারজন জিম্মিকে উদ্ধার করেতে গিয়ে নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেয়া দুইশ‘র বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি সেনারা। পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে কয়েকটি পরিবারকে। এ অভিযানের নাম দেয়া হয়েছিল ‘সিডস অব সামার’ বা ‘গ্রীষ্মের বীজ’।
নুসেইরাত শিবিরে আশ্রয় নেয়া নোরা আবু খামিস নামে অসহায় এক মা বিবিসিকে বলেন, ‘আমার শিশুসন্তানের শরীরের অংশগুলো এক জায়গায় জড়ো করছিলাম, আমার প্রাণের সন্তান। আরেক শিশুসন্তান জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি রয়েছে। এমনকি আমার স্বামী, শাশুড়িসহ পুরো পরিবারই ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরায়েল আমাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করতে চাইছে।’
নুসেইরাত শিবিরে ইসরায়েলের এই অভিযান বিষয়ে বিবিসিকে কিছু তথ্য দিয়েছে আরেজ আল জাহদনেহের নামে দশ বছরের শিশু। তার ভাষ্যমতে, ইসরায়েলি বাহিনী আকাশ থেকে হামলার পাশাপাশি ট্যাংক দিয়ে গোলা ছুড়েছে। এছাড়া তারা গুলিও চালায়।
শিশুটি জানায়, ‘আমরা নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। আমার বোন রিমাজ মাথায় আঘাত পেয়েছে। পাঁচ বছরের আরেক বোনও আহত হয়েছে।’
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের অক্টোবর থেকে চলা ইসরায়েলি হামলায় মৃতের সংখ্যা ৩৭,৩৩৩ ছাড়িয়েছে। আহত হয়েছেন ৮৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অসংখ্যক ভুক্তভোগী মানুষ এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় আটকে রয়েছেন এবং অ্যাম্বুলেন্স ও সিভিল ডিফেন্স ক্রুরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব সত্ত্বেও ইসরায়েল অবরুদ্ধ এ ভূখণ্ডে তার নৃশংস আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে।
এই সংকটের প্রধান কারণ দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক ও সামরিক সংঘাত, যার ফলে সেখানকার জনগণ এক অসম যুদ্ধের বলি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এ সংকট নিরসনে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে গাজার মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারে।
গাজায় এই প্রাণহানি থামানোর জন্য জরুরি মানবিক সহায়তা ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বাড়ানো প্রয়োজন। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক ইস্যু নয়, বরং মানবতার প্রশ্ন। এ যুদ্ধের অবসান হওয়া জরুরি, না হলে আরও অনেক নিরীহ প্রাণ ঝরবে, আর মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রা বাড়তে থাকবে।
মানুষের জীবন রক্ষার্থে ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এখনই পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। আমাদের সকলের উচিত একযোগে এই ভয়াবহ সংঘাতের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা এবং নিরীহ মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
গাজায় চলমান সংঘাতের ফলে যে প্রাণহানি ঘটছে, তা মানবতার জন্য একটি বিরাট সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় ৩৭,৩৩৩ মানুষের মৃত্যু আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যুদ্ধের ভয়াবহতা। এই মৃত্যুগুলি শুধু সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রতিটি জীবন একটি পরিবার, একটি স্বপ্ন, একটি ভবিষ্যত।
এ প্রাণহানি কোথায় গিয়ে থামবে?
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর উদ্যোগ ছাড়া এই সংকটের কোনো স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। গাজা আজ এক মানবিক বিপর্যয়ের মুখে, যেখানে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। খাদ্য, পানি, ওষুধের অভাব এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামোতে বেঁচে থাকার সংগ্রাম প্রতিটি মুহূর্তে তাদের দুর্বল করে দিচ্ছে।
এই সংকটের সমাধানে জরুরি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠনগুলির উচিত সরাসরি হস্তক্ষেপ করা। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করে গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানো জরুরি।
এছাড়া, দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বাড়াতে হবে। ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে শান্তি আলোচনা পুনরায় শুরু করে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা স্থাপন করতে হবে। এই অঞ্চলকে শান্তিতে ফিরিয়ে আনতে হলে উভয় পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে এবং সহিষ্ণুতা দেখাতে হবে।
আমরা সবাই শান্তিপূর্ণ পৃথিবীতে বসবাস করতে চাই। গাজার মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। তাদের আশা, স্বপ্ন এবং মানবিক অধিকারকে সম্মান জানিয়ে একটি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। গাজায় আর যেন একটি প্রাণও না ঝরে, এই আশা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।
সম্ভবত তখনই আমরা বলতে পারবো, আমরা মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়েছি এবং একটি প্রকৃত শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের জন্য কাজ করেছি।
লেখক: মাসউদ বিন আব্দুর রাজ্জাক, নিউজ এডিটর, দীপ্ত টিভি।