বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ৪, ২০২৫
বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ৪, ২০২৫

গণতান্ত্রিক উত্তরণে খালেদা জিয়া এখনো অনিবার্য

Avatar photoদীপ্ত নিউজ ডেস্ক

রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়ন, নির্যাতন, অপমান ও অপদস্থের বিরুদ্ধে একজন নারী একাই দাঁড়িয়ে ছিলেন। স্বামী হারানোর শোক আর সন্তানের শূন্যতা বুকে চেপে রেখে তিনি সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। দীর্ঘ লড়াই ও সীমাহীন যন্ত্রণায় ক্লান্ত হলেও কখনো ভেঙে পড়েন নি, হাল ছাড়েননি। লড়াইয়ের ময়দানে ছিলেন অবিচল। অসীম সাহসের বাতিঘর হয়ে সমস্ত যন্ত্রণাকে পদদলিত করে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন বাংলাদেশের সমন্বিত প্রতিচ্ছবি হয়ে। তিনি ৫৬ হাজার বর্গমাইলের আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া।

বর্তমানে কঠিন সময় পার করছেন হার না মানা এই নেত্রী। ফুসফুসে সংক্রমণসহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা নিয়ে তিনি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ৮০ বছরের জীবনে নানা রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে, যা তার বর্তমান অবস্থাকে অত্যন্ত সংকটাপন্ন করে তুলেছে। গত কয়েক দিনে বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। এ সময় দেশের কোটি কোটি মানুষ তাঁর সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বেগম খালেদা জিয়ার সুস্বাস্থ্য এই মুহূর্তে দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, গণতান্ত্রিক উত্তরণের এই সময়ে বেগম খালেদা জিয়া এখনো অনিবার্য। গনতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও দেশের জন্য খালেদা জিয়ার ত্যাগকে অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন তারা।

তারা বলছেন, অসুস্থতা সত্ত্বেও অভ্যুত্থান পরবর্তী বর্তমান রাজনৈতিক পেক্ষাপটে বিএনপির চেয়ারপারসনের মতো অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদের চিন্তা ও মতামত এই মূহূর্তে ভীষণ জরুরি। বিশ্লেষকদের শঙ্কা, বেগম খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ। কারণ, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান এখন দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে।

সম্প্রতি তার জন্য দোয়া চেয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক উত্তরণের এই সময়ে খালেদা জিয়া জাতির জন্য ভীষণ রকম অনুপ্রেরণা।’

দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেগম খালেদা জিয়ার সুস্থ হয়ে ওঠা কতটা গুরুত্বপূর্ণ জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া সারাজীবন দেশ ও জনগণের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করতে গিয়ে তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে ফ্যাসিস্ট শাসকদের হাতে নির্যাতিত হতে হয়েছে। এ নিযাতন এতটাই কঠোর ছিল যে তিনি অসুস্থ হয়েছেন এবং তার জীবন বিপন্ন অবস্থায় পড়েছে। দেশের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন, তবুও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। তাইতো দেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল এবং সব শ্রেণিপেশার মানুষ তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এটি একজন রাজনৈতিক অভিভাবকের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়।’

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপির তখন কঠিন দুঃসময়। দেশে চলছে এরশাদের সমারিক শাসন। গভীর সংকটে দেশ। সেই সময় ঘোর অনীহা সত্ত্বেও প্রথমে কর্মী এবং পরে দলের হাল ধরতে রাজনীতির মাঠে নামতে হয় বেগম খালেদা জিয়াকে। সেই থেকে শুরু তার চার দশকের রাজনীতির পথচলা। এর মধ্যেই এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সাহসী নেতৃত্ব দিয়ে দেশজুড়ে সাধারণ মানুষের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন আপসহীন নেত্রী। রাজনৈতিক অঙ্গনে পা রাখার আট বছরের মাথায় তিনি দেশের নির্বাচিত প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন।

এরপর তাকে নানা চড়াইউৎরাই পার করতে হয়। কখনো সরকার প্রধান, কখনো বিরোধী দলের নেত্রী হয়ে সরব ছিলেন রাজপথে। এক এগারোর সরকারের সময় এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সময় খালেদা জিয়ার দুঃসহ কারাবন্দী জীবন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অন্যতম ট্রাজেডি। গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বেগম খালেদা জিয়ার প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতিকে অগ্রগণ্য হিসেবে স্মরণ করেন রাজনৈতিক অঙ্গনের ব্যক্তিবর্গ।

বর্তমান পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াই রাজনৈতিক ঐক্যের প্রতিশব্দ উল্লেখ করে ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার যে আপসহীন সংগ্রাম, সেটাই তাকে এই মুহূর্তে একজন অনিবার্য রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশের অভিভাবকে পরিণত করেছে। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোনে বিষেশভাবে তার অনিবার্যতা তৈরি হয়েছে। এই মুহূর্তে তাঁর উপস্থিতি খুবই দরকার। দলটির নেতাকর্মীদের কাছে বেগম জিয়া এক কথায় ‘সিম্বল অব ইউনিটি’। দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছেও তিনি অন্যন্য ব্যক্তিত্ব।’

বেগম খালেদা জিয়ার দীর্ঘ পথচলায় বিভিন্ন সময় তাঁকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার চেষ্ঠাও কম হয়নি। কিন্তু তার তুমুল জনপ্রিয়তা সমস্ত ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছে। গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে থাকায় বিএনপি চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতে বর্তমান বাস্তবতায় দেশ ফের ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে মিথ্যা মামলায় তিনি কারাবরণ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০১৮ সাল থেকেই তিনি বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তেমন অংশগ্রহণ করতে পারেননি। শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর লড়াই করেছে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন দলটি। যে অসুস্থতার কারণে তিনি আজ মৃত্যুর মুখোমুখি, এর পেছনে হাসিনা সরকারের ষড়যন্ত্র ক্রিয়াশীল ছিলএমন অভিযোগও রয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অসুস্থতার কারণে রাজনীতির মাঠে সশরীরে অনুপস্থিত থাকলেও তিনি এখনো দলের লাখো কর্মীর আবেগ ও অনুপ্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু।

বেগম খালেদা জিয়ার দ্রুত সুস্থতা কামনা করে বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘খালেদা জিয়া রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে এত বছর ধরে দেশের গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যুদ্ধ করেছেন। অনেক কষ্ট পেয়েছেন, জেলে গেছেন এবং অনেক কটুকথা শুনেছেন। কিন্তু তিনি পাল্টা প্রতিশোধ নেননি। প্রতিকূল পরিস্তিতিতেও তিনি দেশ ছেড়ে যাননি।’

তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়া সব সময় বলেছেন, ‘এই দেশ আমার, এই দেশ ছেড়ে কোনো দিনই যাব না, এই দেশের জনগণের সঙ্গে আমি থাকব।’ সেজন্য দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে তিনি একটি জায়গায় পৌঁছে গেছেন। যাকে আমরা বলি ‘মুরব্বি’। তাঁর উপদেশের জন্য সবাই তাকিয়ে থাকে। সেই রকম একটা জায়গায় তিনি পৌঁছে গেছেন। এই মুহূর্তে তাঁর সুস্থ হয়ে ফিরে আসা দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বেগম খালেদা জিয়া সুস্থ হয়ে ফিরে আসার জন্য দল ও গোটা দেশ প্রতিক্ষায় আছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমাদের দলীয় চেয়ারপার্সন এই দেশের গণতন্ত্র, মানুষের ভোটাধিকার ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য আপসহীন সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি শুধু বিএনপি নয়, এ দেশের সাধারণ মানুষের আশাআকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তিনি আছেন গণতন্ত্রের দৃঢ়তম প্রতীক হিসেবে। আমাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সংকটাপন্ন অবস্থায় এখন হাসপাতালে আছেন। আমরা সবাই তাঁর রোগ মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে দোয়া করছি। তিনি দ্রুতই আমাদের মঝে ফিরে আসবেন।’

রাজনৈতিক অঙ্গনে বেগম খালেদা জিয়ার দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ ও দৃঢ় অবস্থান দেশের জন্য এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায় উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘দেশের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রামে সব সময়ই আমাদের নেত্রী আপসহীন ছিলেন। গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সুস্থতা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার জন্য অপরিহার্য।’

দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া হলেন বাংলাদেশের কোটি কোটি প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠস্বর, এমনটাই উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, রাজপথে আন্দোলন করে সম্মুখ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করে তিনি রাজনীতিতে তার আসন প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি দেশের বঞ্চিত মানুষের গণতান্ত্রিক তথা অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। শুধু তাই নয়, নীতির প্রশ্নে তিনি চিরদিন ছিলেন অবিচল। আর সে কারণেই এদেশের মানুষ ভালোবেসে তাঁকে উপাধি দিয়েছে ‘আপসহীন নেত্রী’।

. মঈন খান বলেন, ‘রাজনীতিতে যে অনন্য গুণটির অধিকারী বেগম খালেদা জিয়া, তা হলোতিনি কোনোদিন প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নন। তাছাড়া কেউ কোনো ভুল করলে তিনি সব সময় সেটা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখে থাকেন।

তিনি বলেন, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার আন্দোলনে বেগম খালেদা জিয়া কয়েক দশক ধরে অবিচল ভূমিকা পালন করেছেন। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রচক্রের লাগাতার নির্যাতন, মিথ্যা মামলার পরিক্রমা এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ভয়াবহতার মাঝেও তার অটল মনোবল ও আপসহীন অবস্থান বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, ১৯৯০এর গণঅভ্যুত্থান, স্বৈরতন্ত্রবিরোধী সংগ্রাম এবং পরবর্তী সময়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রত্যেকটি পর্বে খালেদা জিয়ার দৃঢ়তা, দেশপ্রেম ও নেতৃত্ব জাতীয় জীবনে গভীর প্রভাব রেখেছে। বাংলাদেশের বহু প্রজন্ম তাকে দেখেছে সাহস, সহনশীলতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতীক হিসাবে।

আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন। দীর্ঘ প্রতিকূলতা, সীমাহীন চাপ ও কঠিন বাস্তবতার মাঝেও তিনি যে দৃঢ়তা, সাহস ও আপসহীন নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে উজ্জ্বল অক্ষরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার সুস্থতা শুধু নিজের দলের জন্য নয়, বরং দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ, গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা এবং মানবিক মূল্যবোধ রক্ষার জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে ক্ষমতার ট্রানজিশনাল পর্যায়ে তার মতো অভিজ্ঞ নেত্রীর উপস্থিতি জাতীয় স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

আরও পড়ুন

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More