পুলিশ অফিসার্স মেস একদম সৈকত লাগোয়া। চোখ মেললেই সাগর দর্শন। ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠেছি। সাগর বেশ শান্ত। সৈকতে কোলাহল নেই; দু’একজন ‘পর্যটক’ ইতিউতি ঘুরছেন। এরা অবশ্যই আমজনতা নন, হয়তো কবি। সুনীল সাগর দেখে, শীতল সমীরণ গায়ে মেখে দিলে যদি ভাব আসে তবে কলম ধরবেন। ওদিকে সাধারণ বাঙালি কিন্তু গভীর ঘুমে ডুবন্ত। দুরমুশ ছাড়া দুপুরের আগে তোলা মুশকিল। অবশ্য গতরাতে তাঁরা বেশ ব্যস্ত ছিলেন। রাত তিনটা পর্যন্ত সাগর পাড়ে থেকে হয়রান হয়ে হোটেলে ফিরেছেন। সংখ্যা ধরলে কাতারে কাতার, হাজারে হাজার। তাঁরা সাগর পাড়ে কী করে, কী দ্যাখে কেউ জানে না। শুধু ঢেউ আসলে বেড়ালের মতো একটু পা ভিজায় আর জোরে জোরে চিল্লায়। কী ছেলে, কী মেয়ে, বুড়া-বুড়ি একই কাম। এতোকিছু জানলাম ক্যামনে? রাতে তাঁদের সাথে আমরাও কিছুক্ষণ ছিলাম যে!
ডিনার শেষে মাহবুব যখন বললো, “খাওয়ার পরে একটু হাঁটাহাটি ভালো”, তখনই বুঝলাম সে সাগর পাড়ে যেতে চায়। গেলামও। ভাঙন ঠেকাতে জিও ব্যাগ দিয়ে বিশাল বালুর বাঁধ দেয়া হয়েছে। ওসবের ওপর দিয়ে সৈকতে নামা খুব ঝক্কির ব্যাপার। ভাগ্যিস আমাদের পায়ে কেডস ছিল এবং হাতে কোনো ‘অবলা’ ছিল না। এমন জায়গায় যাঁরা হাইহিল পরে আসেন তাঁদের কী অবস্থা হয়? সেই হাইহিল পা থেকে প্রথমে নিজের হাতে উঠে এসে সময়ে কার হাতে ট্রান্সফার হয় তা জানা আছে আমার। এমন রোমান্টিক জায়গায় এসেও ‘উপযুক্ত সঙ্গী’ এক জোড়া জুতা হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভেবে একচোট হেসে নিলাম।
আমরা কলাতলীর দিকে হাঁটছি। শুক্রবার হওয়ায় ভীড়াক্কার। দূরে ট্যুরিস্ট পুলিশের সাইনবোর্ডের আলো ছাড়া সৈকতে কোন আলো নেই। মেয়ে-ছেলে ‘হারিয়ে’ যাওয়ার মতো ঘুটঘুটে চারিদিক। মানুষের ভীড় আর গর্জনের মাঝে হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠলো। দেখি জাহাঙ্গীর। সে আমার সহপাঠী, বন্ধু। ব্যবসায় উপলক্ষে এখন কক্সবাজারের বাসিন্দা। আমার আগমন বার্তা আগেই দিয়ে রেখেছিলাম। ফোন ধরতেই বললো,
–মামু, তুমি কোথায়?
–বীচে। আমি সকালে বান্দরবান চলে যাবো। মামীকে সালাম দিও।
–আরে আমি রাস্তায় চলে এসেছি। কোথায় যাবো, বল্?
–কলাতলী
জাহাঙ্গীর আমাদের সাথে শুদ্ধ ভাষায় কথা বললেও স্থানীয়টা এমনভাবে রপ্ত করেছে যে, মনে হবে তাঁর চৌদ্দগুষ্টি আরাকান থেকে এসেছে। এবং ইহজনমে পটুয়াখালীর নামও শোনেনি। ওর এই ব্যুৎপত্তি অবশ্য একবার খুব কাজে এসেছিল। গল্পটা বলি।দিনাজপুরের হিলি সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় আণ্ডাবাচ্চাসহ এক পরিবার আটক হয়। এরপর সোজা এসপি অফিসে ‘চালান’ দিলে ভর দুপুরে আমার সামনে এসে হাজির। এদের ভাষা কর্ণকুহরে সুন্দরভাবে ঢুকে কিন্তু কারো বাপের সাধ্য নেই যে তা বোঝে। একবার ভাবি ব্যাচমেট মনিরকে ইন্টারপ্রেটার হতে বলি। কারণ সে চাটগাঁর ভাষা বোঝে, বলেও বেশ ভাল। এমনকি গালিগালাজ পর্যন্ত শিখে নিয়েছে। এমন ভাবনার মাঝে হঠাৎ করে জাহাঙ্গীর ঢুকে পড়ে। মনে হলো ‘আরাকানী’ জাহাঙ্গীর থাকতে মনির কেন? ফোনে পুরো বিষয়টা বলে সেই বাচ্চাদের মায়ের সাথে জাহাঙ্গীরকে কথা বলিয়ে দিই। দুই মিনিটেই মুশকিল আসান। ও বলে, মামা, জিনিস এখানকার। এমনকি কোন্ পাড়ায় থাকতো সেটাও বলে দিলো। জ্বী, উনারা রোহিঙ্গা পরিবার। পরে এসকর্ট করে কক্সবাজারে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।
সেই জাহাঙ্গীর এখন আমার সামনে। মাহবুবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। সে আমাদের অনেক কিছু খাওয়াতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত ডাবে রফা হয়। তবে একটা নয়, দু’টো। এই ডাবের পানি মাঝ রাতে আমায় ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের কথা মনে করিয়ে দেয়। কী বিস্বাদ! এমনটা কেবল বালিতেই পাওয়া সম্ভব। তবে বালি’র ডাব দেখতে বেশ সুন্দর, পানিও প্রচুর। এখানকারটা দেখতে ‘কদাকার’।
পূবের সোনালী রোদ জলের ওপর চিক চিক করছে। আকাশটা নীল ব্যাকড্রপ হয়ে বহুদূরে ঝুলে আছে। এমন সকাল আমার খুব ভালো লাগে। তবে বেশি উদাস হওয়া গেল না কারণ সত্ত্বর রেডি হতে হবে। মাহবুব ফজরের নামাজ ওয়াক্তমতো পড়ে। যে সকল মুত্তাকি ফজরের নামাজ পড়েন তাঁদের সাথে কোনোমতেই পারা যায় না। এঁরা খুব সকালে উঠে বসে থাকেন। সময়মতো অফিসে যান; আমাদের ভাষায় যাকে বলে ‘Too early’। কেউ কেউ অবশ্য বাসায় ফেরেন দেরি করে। বেকায়দা সিনসিয়ার! মাহবুবও তেমন একজন ‘কাজ পাগল’। সকাল সকাল অফিসে গিয়ে দিনে গোটা পাঁচেক মিটিং করে। যেদিন মিটিং থাকে না সেদিন মিটিং পয়দা করে। সেজন্যে ডিআইজি (মিটিং) বলে আমরা ওকে ক্ষ্যাপাই। সে দীর্ঘদিন স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) এ ছিল। এরা রাষ্ট্রপতি -প্রধানমন্ত্রীসহ ভিভিআইপিদের নিরাপত্তা দেয়। সার্ভিসে এদেরকে এজেন্ট বলা হয়। এজেন্টরা সাধারণত খুব সময়ানুবর্তী, অ্যাজাইল ও শার্প শ্যুটার হয়। আমার সাথে মাহবুবের পার্থক্য ঠিক এখানটায়।
আমরা সপরিবারে একই বিল্ডিংয়ে থাকি। ঢাকার বাইরে কোনো প্রজেক্ট দেখতে গেলে তাঁর একটাই কথা, ফার্স্ট ফ্লাইটে যাবো। ‘কষ্ট’ হলেও আমি কখনো না করি না। যাত্রার দিন মাহবুব ফজরের নামাজ পড়ে প্রথমে একটা ওমলেট বানিয়ে খায়। তারপর চিনি ছাড়া চায়ের কাপ হাতে নিয়ে গজল শুনতে থাকে। সাধারণত নির্ধারিত সময়ের একটু আগেই নীচে নেমে গাড়িতে বসে থাকে। হন্তদন্ত হয়ে ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে আমাকে নামতে দেখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, ইউ’র লেইট বাই থ্রি মিনিটস্। নেভার মাইন্ড।
সাড়ে সাতটায় রওয়ানা হওয়ার কথা। ব্যাগ গুছিয়ে রেখে ব্রেকফাস্টের তালাশে বের হলাম। দেখি মাহবুব লবিতে বসে আছে। রাতেই এসপি কক্সবাজারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিয়েছি। ব্রেকফাস্ট শেষ করে বিল মিটিয়ে নীচে নামতে নামতে প্রায় আটটা বেজে গেলো। পরের গন্তব্য বান্দরবানের থানচি।
কক্সবাজার থেকে থানচি দু’ভাবে যাওয়া যায়। লামা হয়ে আলী কদম দিয়ে সাড়ে তিন ঘন্টার পথ। কিন্তু আমাদের ড্রাইভার বললো, ওদিকে পাহাড় উঁচা, অটো গিয়ারে চালানো কঠিন। তাইলে উপায়? উপায় হলো বান্দরবান। বান্দরবান গিয়ে তারপর থানচি যাওয়া। অতএব এক ধাক্কায় তিন ঘন্টার যাত্রা ছয় ঘন্টায় গিয়ে ঠেকলো। বাধ্য হয়ে আমরা বান্দরবানের পথ ধরলাম। লম্বা রুট। তবে আমাদের কোনো তাড়া নেই।
এমন যাত্রায় ইউটিউব খুবই দরকারি ‘সঙ্গী’। মাহবুব পাঁড় গজল শ্রোতা। আমার ঠিক-ঠিকানা নেই, সব কিছু চলে। ভেবেচিন্তে নুসরাত ফতেহ আলী দিলাম। এন্ড্রয়েডে ‘সাঁসো কি মালা পে সিমরু ম্যায় পি কা নাম’ বাজতে রইলো। ভালো লাগছিলো। মীরা বাঈয়ের এ ভজন জীবনে কতবার যে শুনেছি ঠিক নেই। এটা অনেকেই গেয়েছেন; বলিউডেও জায়গা পেয়েছে। তবে নুসরাত ফতেহ আলীর ধারেকাছেও কেউ নেই। ফতেহ আলী শুনতে শুনতে আমরা চোখ বুজে ফেললাম।
রাস্তায় প্রচুর ট্রাফিক। বারবার গতি কমে যাচ্ছে। মহাসড়কে ওঠা বারণ এমন অনেক যানবাহন হরদম চলছে। এটার হয়তো যুক্তিসঙ্গত ‘প্রয়োজন’ আছে কিন্তু দরকারি অনুমতি নেই। বিদেশে মহাসড়কের সাথে সার্ভিস লেন থাকে। যেমনটা ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে আছে। তেমনটা থাকলে অটোরিকশা, ভ্যানসহ অপ্রচলিত যানবাহনের যাতয়াত সহজ হয়। কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দ্রুত সময়ে চার লেন হওয়া প্রয়োজন। আশাকরি সেটা হয়ে যাবে।
জায়গাটার নাম কেরানি হাট। ঢাকার অদূরে কেরানি গঞ্জ আছে। তাইলে কি এর পাল্টা হিসেবে কেরানি হাট চট্টগ্রামে? জনৈক ‘কেরানি বাবু’ সাতকানিয়ায় হাট বসালেন, ঢাকায় গঞ্জ বসালেন তো ‘সাহেব-সুবার’ কী কাজ? জায়গামতো তাঁদেরও কিছু ‘বসানো’ উচিত ছিল। কিন্তু তেমন নজির চোখে পড়ে না, মনেও পড়ে না। আসলে সাহেবরা সব মোসাহেবি নিয়ে ব্যস্ত। তাঁদের ‘কামের’ সময় থাকলেও কাজের সময় নেই।
কেরানি হাট থেকে ডানের রাস্তা আমাদের বান্দরবান নিয়ে যাবে। পুলিশ প্রটেকশন পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। শুরুতে সমতল। শেষে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় এসে পড়লো। সাগর পাড়ে জন্মেছি; পাহাড় বড় দূরের জিনিস। দূরের বলেই হয়তো টানে বেশি।
পথে দেখা নানা জায়গা গুলোর নাম বেশ সুন্দর। হলুদিয়া বাজার, সুয়ালক বাজার। খুব নরম, রোমান্টিক নাম। একটা সেনাচৌকি পেরিয়ে এলাম। কিছুক্ষণ পর গাড়ি শহরে ঢুকলো। বান্দরবান। টিপিক্যাল ছোট্ট শৈল শহর। এর আগেও একবার আসা হয়েছে কিন্তু নসিবে না থাকায় দেখা হয়নি। নসিব দেখছি এবারও ভালো নয়। তবে বাউল শামসুল হক চিশতী গেয়েছেন, “যদি থাকে নসিবে আপনি আপনি আসিবে”। উনি নিশ্চয়ই ‘ফল’ না পেয়ে ‘আপনি আপনি’ এটা বলেননি। অতএব অবশ্যই ‘আসিবে’।
তবে সমস্যা একটাই। সেটা হলো, আমার বরাতে কোনোকিছুই ‘আপনি আপনি’ আসে না।
বড়ই আফসোস।
(চলবে)
লেখক: রুহুল আমিন শিপার
ডিআইজি, বাংলাদেশ পুলিশ