বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ৫, ২০২৪
বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ৫, ২০২৪

এমপক্সের লক্ষণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

Avatar photoদীপ্ত নিউজ ডেস্ক

২০২২ থেকে ২০২৩ সালে যুক্তরাজ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এমপক্স। এটি ছিল আফ্রিকার বাইরে বিশ্বব্যাপী এমপক্স প্রাদুর্ভাবের প্রথম ঘটনা। ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালে এর বিস্তৃতি ঘটে কঙ্গো, উগান্ডা, কেনিয়া, রুয়ান্ডা ও বুরুন্ডিতে। এমনকি ইউরোপের দেশ সুইডেনেও ধরা পড়তে শুরু করে এমপক্স আক্রান্ত রোগী। সম্প্রতি এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে এমপক্স আক্রান্তের তালিকায় যুক্ত হয় পাকিস্তান। ফলে এমপক্স নিয়ে বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত কোনো এমপক্স রোগী ধরা না পড়লেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ সতর্কতা বজায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চলুন, এমপক্স সংক্রমণের কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসার উপায়গুলো জেনে নেওয়া যাক।

এমপক্স সংক্রমণের কারণ

এই রোগের সৃষ্টি হয় অর্থোপক্স ভাইরাস এমপক্সের মাধ্যমে, যার পূর্ব নাম ‘মাঙ্কিপক্স ভাইরাস’। এই জুনোটিক ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে থাকে মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণীর মাধ্যমে। ভেরিওলা ভাইরাস, (যেটি মূলত গুটিবসন্ত সৃষ্টি করে), কাউপক্স এবং ভ্যাক্সিনিয়া ভাইরাসের সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ভাইরাসটি ক্ল্যাড১ এবং ক্ল্যাড২ নামে দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত। ক্ল্যাড ২এর রয়েছে আরও দুটি সাবক্যাটাগরি: ক্ল্যাড২এ ও ক্ল্যাড২বি।

এর সংক্রমণ শরীরের ত্বক বা শরীর থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন তরলের সরাসরি সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ঘটে থাকে। অপরদিকে, সংক্রমিত পশুর সঙ্গে সংঘর্ষ কিংবা কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমে পশু থেকে পশুতে ছড়িয়ে পড়ে। আর পশু থেকে মানুষে সংক্রমণ ঘটে আক্রান্ত পশুর কামড় অথবা আঁচড় বা পশু শিকার, চামড়া কাটা বা রান্নার মতো কার্যকলাপের সময়। এমপক্স ভাইরাস ত্বক, থুথু, লালা, নাকের পানি ও যৌনাঙ্গের শ্লৈষ্মিক পৃষ্ঠের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। অর্থাৎ কথা বলা, কাশি বা হাঁচির মাধ্যমেও এটি ছড়িয়ে পড়তে পারে।

এমপক্সের লক্ষণ

একদম শুরুতে জ্বর, পেশিতে ও গলায় ব্যথা থাকে। তারপর ধীরে ধীরে চুলকানি বা তীব্র ব্যথাসহ ফুসকুড়ি, মাথাব্যথা, লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া এবং ক্লান্তি যোগ হয়। অবশ্য সবার ক্ষেত্রে উপসর্গের এতটা বিস্তৃতি নাও থাকতে পারে। আপাতদৃষ্টে ফুসকুড়িগুলোর কারণে সাধারণ হাম বা চিকেনপক্স মনে হতে পারে। কিন্তু লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া বিশেষত অন্যান্য পক্স থেকে এমপক্স কে আলাদা করে।

অধিকাংশ লক্ষণ সংক্রমণের ৪ থেকে ১১ দিন পরে দৃষ্টিগোচর হওয়া শুরু হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রথম দিনেই গুরুতর অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

অনেক ছোট ছোট ক্ষতের সমন্বয়ে গঠিত হয় ফুসকুড়িগুলো, যা হাতের উভয় পৃষ্ঠ, মুখ, গলা, যৌনাঙ্গ বা মলদ্বারে প্রদর্শিত হয়ে থাকে। শুরুটা হয় ছোট ছোট সমান দাগ দিয়ে। অতঃপর ফুলেফেঁপে ওঠার আগ মুহূর্তে ভেতরে তরল পুঁজে পূর্ণ হয়ে যায়। পরে তা ফেটে গিয়ে প্রায় ১০ দিন চামড়ায় থেকে যায়। বিরল ক্ষেত্রে ক্ষতগুলোতে ইনফেকশন হয়ে চামড়ায় নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে, যা সেরে উঠতে যথেষ্ট সময় লাগতে পারে।

গোটা শরীর জুড়ে এই ক্ষতগুলো যে শুধু একসঙ্গে অনেকগুলো দেখা দেয় তা নয়। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে শুধু একটি ঘা থাকে। কারো কারো ক্ষেত্রে এমনকি কোনো লক্ষণ নাও দেখাতে পারে। লক্ষণগুলো সাধারণত ২ থেকে ৪ সপ্তাহ স্থায়ী হয়। তবে দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার রোগীদের ক্ষেত্রে তা আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।

চরম পর্যায়ে সেকেন্ডারি ইনফেকশন, নিউমোনিয়া, সেপসিস, এনসেফালাইটিস ও দৃষ্টিশক্তিও হারিয়ে যায়। দুর্বল রোগীদের ক্ষেত্রে এই রোগ আরও গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। গর্ভাবস্থায় এই ভাইরাস সংক্রমণ মৃত সন্তান প্রসব বা অন্যান্য জটিলতার কারণ হতে পারে।

এমপক্স প্রতিরোধের উপায়

এই রোগের বিরুদ্ধে বিশেষভাবে কোনো ভ্যাকসিন এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি, তবে গুটিবসন্তের টিকা অনেকাংশে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।

আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত ইউরোপ, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড ও কানাডা জুড়ে শুধু একটি টিকা অনুমোদিত হয়েছে। এর নাম এমভিএবিএন, যার পূর্ণ রূপ মডিফাইড ভ্যাক্সিনিয়া আঙ্কারাবাভ্যারিয়ান নর্ডিক। ভ্যাকসিনটি তৈরি হয়েছে অর্থোপক্সভাইরাসের সম গোত্রভুক্ত ভ্যাক্সিনিয়া ভাইরাস থেকে। এটি সাধারণত ২৮ দিনের ব্যবধানে দুটি মাত্রায় দেওয়া হয়।

বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনে আরও ৩টি ভ্যাকসিন রয়েছে। এগুলো হলোজাপানের এলসি১৬, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার এসিএএম২০০০ এবং রাশিয়ার অর্থোপক্সভ্যাক।

তবে বর্তমানে ডব্লিউএইচও অনুসারে, এখনও বিশ্বব্যাপী গণ টিকাদান কর্মসূচির সময় আসেনি। যারা ঝুঁকিতে আছেন বা ভাইরাসের সংস্পর্শে এসেছেন, শুধু তাদের এসব টিকা দেওয়া যেতে পারে।

তাছাড়া এগুলোর সবই মূলত প্রস্তুত করা হয়েছিল গুটিবসন্ত ও অর্থোপক্স গোত্রের অন্যান্য ভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে। একক ভাবে এমপক্সের জন্য ভ্যাকসিন তৈরি এখনও গবেষণাধীন।

এমআরএনএ ভ্যাকসিন বিএনটি১৬৬ বিশেষভাবে মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়। এটি নিয়ে বিশদ পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। এখানে উল্লেখ্য যে, কোভিড১৯এর জন্য বানানো ভ্যাকসিনের মতো এটিও একটি এমআরএনএ ভ্যাকসিন।

উপরুন্ত, সুনির্দিষ্ট ভ্যাকসিনের অনুপস্থিতিতে এমপক্স ভাইরাসের সংক্রমণ বা বিস্তার রোধ করতে ঘরোয়াভাবে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। সেগুলো হলো

ফুসকুড়ি আছে এমন লোকেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এড়িয়ে চলা।

সংক্রামিত প্রাণী ও তার ব্যবহৃত কিংবা তার সংস্পর্শে থাকা কাপড়, চাদর, কম্বল বা অন্যান্য উপকরণগুলো থেকে দূরে থাকা।

সরাসরি এমপক্স আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ ব্যক্তিদের থেকে আলাদা অবস্থানে রাখা।

সংক্রামিত ব্যক্তি বা প্রাণীর সঙ্গে যোগাযোগের পরে সাবান ও বিশুদ্ধ পানি দিয়ে হাত ভালোভাবে ধুয়ে নেওয়া। বিশেষ করে খাওয়ার আগে বা মুখ স্পর্শ করার আগে এবং টয়লেট ব্যবহারের পরে। সাবান ও পানি পাওয়া না গেলে বিকল্প হিসেবে অ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা যেতে পারে।

অর্থোপক্স ভাইরাস বহন করতে পারে এমন সব গৃহস্থালি বা পোষা প্রাণী এড়িয়ে চলা।

এমপক্স রোগের চিকিৎসা

অধিকাংশ ক্ষেত্রে লক্ষণ দেখা দেওয়ার ২ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যে সংক্রমণের প্রভাব ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হতে শুরু করে। এর মধ্যে রোগের ক্ষতিকর দিকগুলো থেকে রক্ষা পেতে সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। তবে এমপক্সের গুরুতর অবস্থায় বেশ ভালো কাজ দেওয়ায় প্রতিষেধক হিসেবে টেকোভিরিমাট ও সিডোফোভির প্রেস্ক্রাইব করা হয়। এছাড়া প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ভ্যাক্সিনিয়া ইমিউন গ্লোবুলিন দেওয়া হতে পারে। মূলত গুটিবসন্তের মতো অন্যান্য ভাইরাসজনিত সংক্রমণের চিকিৎসার ক্ষেত্রে এই ওষুধের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।

প্রাথমিক স্তরে উপসর্গ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তিকে অন্য সবার থেকে আলাদা রাখা উচিত। এ সময় তাকে হাইড্রেটেড রাখার জন্য পর্যাপ্ত পানি ও ভালো খাবার দেয়ার পাশাপাশি তাকে দুশ্চিন্তা মুক্ত রাখতে হবে।

এই রোগের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা রোগীদের মধ্যে রয়েছে শিশু, গর্ভবতী নারী, বয়স্কসহ দুর্বল রোগ প্রতিরোধ সম্পন্ন ব্যক্তিরা। এদের যথা শিগগিরই হাসপাতালে ভর্তি করে বিশেষ পর্যবেক্ষণ ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।

এমপক্স নির্ণয়ের জন্য প্রথমেই একটি উন্মুক্ত ক্ষত থেকে টিস্যুর নমুনা নেওয়া হয়। এটি পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (পিসিআর) পরীক্ষার (জেনেটিক ফিঙ্গারপ্রিন্টিং) জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়। এছাড়া রোগীর সর্বশেষ রোগ প্রতিরোধ অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য তার রক্ত পরীক্ষাও করা হয়।

শেষাংশ

সাধারণ ক্ষেত্রে ২ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যে এমপক্সএর লক্ষণগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তবে ঝুঁকিপূর্ণ লোকদের জন্য এর জটিলতাগুলো মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। তাই দেশে প্রাদুর্ভাবে পরিণত হওয়ার আগেই মাঙ্কি পক্সের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্বন্ধে জেনে থাকা জরুরি। সক্রমণ এড়াতে যে ব্যক্তি, প্রাণী ও বস্তুর এমপক্স আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, সে সবকিছু থেকে দূরে থাকতে হবে। সুনির্দিষ্ট ভ্যাকসিন এখনও গবেষণাধীন থাকায় চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া আবশ্যক। সম্মিলিতভাবে সতর্ক থাকা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পথ্যবিধি মেনে চলার মাধ্যমে কাটিয়ে ওঠা যাবে আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি।

 

সুপ্তি/ দীপ্ত সংবাদ

আরও পড়ুন

সম্পাদক: এস এম আকাশ

অনুসরণ করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন

স্বত্ব © ২০২৩ কাজী মিডিয়া লিমিটেড

Designed and Developed by Nusratech Pte Ltd.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More