মাসউদ বিন আব্দুর রাজ্জাক
এই মুহূর্তে আমরা এক প্রযুক্তিগত বিবর্তনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। একসময় বিদ্যুৎ যেমন বদলে দিয়েছিল উৎপাদনের ধারণা, ইন্টারনেট যেমন ভেঙে দিয়েছিল যোগাযোগের সীমা। ঠিক তেমনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার। প্রশ্ন উঠছে- এটি কি আশীর্বাদ, না অভিশাপ? এটি কি সভ্যতা গড়বে, না ধ্বংস করবে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আসলে নির্ভর করে, আমরা এআই-কে কীভাবে দেখি, কীভাবে ব্যবহার করি এবং কতটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি।
এআই-কে দাজ্জালের সঙ্গে তুলনা করে যেভাবে এক ভয়ঙ্কর, শয়তানি ভবিষ্যতের ছবি আঁকা হচ্ছে, তা হয়তো কাল্পনিকভাবে আকর্ষণীয়, কিন্তু বাস্তবতায় তা অত্যন্ত সরলীকৃত ও বিপজ্জনক। কারণ, প্রযুক্তি নিজে ভালো বা খারাপ নয়, এর ব্যবহারের ধরনই নির্ধারণ করে সেটি মানবজাতির জন্য উপকারী হবে, না ক্ষতিকর। বিদ্যুৎ যেমন আলো দিতে পারে, আবার অস্ত্রকেও চালাতে পারে। এআই-ও তেমনই এক শক্তি, যার উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণই হবে ভালো-মন্দের চাবিকাঠি।
এআই আমাদের লেখে দিচ্ছে, ছবি বানিয়ে দিচ্ছে, এতে অনেকে বলছেন, মানুষের চিন্তার ক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। কম্পিউটার আসার পর মানুষ তার গণনা বন্ধ করেনি, বরং নতুন সমস্যার ধরন খুঁজেছে। ক্যালকুলেটর আসার পর মানুষ অংক শেখা বন্ধ করেনি, বরং জটিল অ্যালগরিদমে প্রবেশ করেছে। আজও এআই ব্যবহারকারীরা কল্পনাশক্তির চূড়ায় উঠে নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে। যেমন- একজন ফটোগ্রাফার Midjourney-কে দিয়ে নিজের চিন্তার দৃশ্যায়ন করছে।
একটি প্রচলিত আশঙ্কা হলো- এআই নাকি নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেবে, মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করবে। অথচ বাস্তবে, ChatGPT, Gemini, বা Midjourney—এগুলো সবই মানুষের হাতে তৈরি এবং নিয়ন্ত্রিত মডেল। প্রতিটি ভাষা মডেল, প্রতিটি চিত্র উৎপাদক অ্যালগরিদম নির্দিষ্ট প্রম্পট, ডেটাসেট এবং এথিক্যাল গাইডলাইন অনুযায়ী কাজ করে। অধিকন্তু, ইউরোপীয় ইউনিয়নের এআই অ্যাক্টসহ বিশ্বের বহু দেশে এআই নীতিমালা গঠনের কাজ চলছে; যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষায় নিয়ম-কানুন স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হচ্ছে।
এআই-কে ‘দাজ্জাল’ রূপে চিত্রিত করা কেবল ধর্মীয় আবেগকে প্রযুক্তিগত বাস্তবতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার চেষ্টা নয়, বরং এটি একটি দায়িত্বহীন ও বিপজ্জনক দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গি ইসলাম অনুসারীদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন থেকে বিরত রাখার দুরভিসন্ধি ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা বোঝার জন্য খুব বেশি দূরে যেতে হবে না, মাত্র এক-দেড় শতাব্দী আগে এই উপমহাদেশের দিকে তাকালেই উত্তর মিলবে। ইংরেজি শিক্ষা ‘হারাম’ ফতোয়া দিয়ে এ অঞ্চলের মুসলমানদের কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। একই কায়দায় এআই-কে ‘ফিতনা’ আখ্যা দিয়ে নিজেরাই ফিতনা সৃষ্টির পায়তারা করছে নব্য ফিতনাবাজরা। তবে, আশার দিক হচ্ছে, মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। এই ফতোয়াবাজদের এখন আর কেউ বিশ্বাস করে না।
হাদিসে দাজ্জাল মানবরূপী এক ফিতনার কথা বলা হয়েছে, যার প্রেক্ষিত ছিল একটি আত্মিক, আধ্যাত্মিক বিভ্রান্তি। এটি কোনো প্রযুক্তিগত যন্ত্র নয়। এআই-এর চ্যালেঞ্জ আত্মিক না, বরং নীতিনৈতিকতার, রাজনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত; যার সমাধান আসতে পারে বিজ্ঞান, মুক্তমত ও ন্যায্যতার জায়গা থেকে।
এআই-কে যদি ‘নতুন সভ্যতা’ বলা হয়, তবে তা হওয়া উচিত মানবিক সভ্যতার সম্প্রসারণ। এআই চিকিৎসায় রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করছে, কৃষিতে ফলন বাড়াচ্ছে, দুর্যোগ পূর্বাভাসে ভূমিকা রাখছে, এমনকি অবহেলিত মানুষের কণ্ঠকে পৌঁছে দিচ্ছে মূলধারায়। এআই কোনো অলৌকিক ‘নতুন প্রভু’ নয়; এটি মানুর সৃষ্টি, মানুষেরই অধীন থাকবে।
পরিশেষে বলতে চাই, এআই ফিতনা নয়, এটি একটি টুল। এটিকে আমরা কীভাবে ব্যবহার করি, সেটাই নির্ধারণ করবে আমাদের ভবিষ্যৎ। বিভ্রান্তির ভাষা নয়, দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা। ভয় নয়, দরকার প্রস্তুতি। কারণ সভ্যতা গড়ে ওঠে কর্মে, কল্পনায় নয়।
এখন প্রয়োজন একটি অংশগ্রহণমূলক, দায়িত্বশীল, নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। শিক্ষা ব্যবস্থায় এআই লিটারেসি, নীতিভিত্তিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক আইন ও নৈতিক গাইডলাইনই হতে পারে ভবিষ্যৎ সুরক্ষার ভিত্তি।
লেখক: নিউজ এডিটর ও অনলাইন ইনচার্জ, দীপ্ত টেলিভিশন