বৃহস্পতিবার, ১৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১লা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৪ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
বৃহস্পতিবার, ১৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১লা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৪ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

ঊর্মির বিতর্কিত মন্তব্য: মতাদর্শিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিকার

দীপ্ত নিউজ ডেস্ক
17 minutes read

মাসউদ বিন আব্দুর রাজ্জাক

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক (ডিসি) কার্যালয়ের সদ্য সাবেক সহকারী কমিশনার (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) তাপসী তাবাস্সুম ঊর্মির সাম্প্রতিক ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে যে বিতর্ক উঠেছে, তা আমাদের সমাজের গভীরতর নৈতিক ও মতাদর্শিক সংকটের ইঙ্গিত বহন করে।

ঊর্মি তার স্ট্যাটাসে ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে শহীদ আবু সাঈদকে নিয়ে লিখেন, “মানে কত বড় বোকার স্বর্গে আছি, এইটা শুধু চিন্তা করি। আবু সাইদ! বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, ‘সন্ত্রাসী’ একটা ছেলে, যে কিনা বিশৃঙ্খলা করতে গিয়ে নিজের দলের লোকের হাতেই মারা পড়ল, সে নাকি শহীদ! এটাও এখন মানা লাগবে! আর এই আইন ভঙ্গকারী সন্ত্রাসীর জন্য দেশের অথর্ব অতি প্রগতিশীল সমাজ কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়েছে।

তখন যাকেই বলার চেষ্টা করেছি, পুরো ঘটনা তদন্তসাপেক্ষ, সেই দশটা কথা শুনিয়ে দিয়েছ। প্রশাসনে থেকে সরকারের দালাল হয়ে গেছি, এ কথা বোঝানোর তো বাকিই রাখনি। এই যে একটা সন্ত্রাসীর মৃত্যুকে অজুহাত বানিয়ে কত নিরীহ পুলিশ ভাইদের হত্যা করা হলো, তার দায়ভার কি এই অথর্ব সমাজ নিবে? এই ছেলের জন্য প্রধান উপদেষ্টা তার দলবল নিয়ে চলে এলেন রংপুর।”

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বাধীন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গত ১৬ জুলাই গুলিতে নিহত হন পুলিশের অস্ত্রের সামনে বুক টান করে দাঁড়ানো রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ। তার এ আত্মত্যাগ দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে, যার ফলে কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের অভ্যুত্থানে। সেই অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার আগে দেশে ফিরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বক্তব্য দেয়ার শুরুতেই শহীদ আবু সাঈদকে স্মরণ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ গ্রহণের দুই দিন পর ১০ আগস্ট রংপুরের পীরগঞ্জের বাবনপুরে আবু সাঈদের বাড়িতে গিয়ে তার কবর জিয়ারত করেন প্রধান উপদেষ্টা।

সে প্রসঙ্গ টেনে ঊর্মি তার স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘লালমনিরহাট থেকে এই উপদেষ্টা দলের জন্য আবার পাঠাতে হয়েছে গাড়ি। রংপুরের বাকি সাত জেলা থেকেও গাড়ি পাঠাতে হয়েছে। এই আহাম্মকি ভ্রমণের জন্য এত বড় গাড়িবহর পুরো বিভাগ থেকে যে গেল, তার তেল খরচ কে দিয়েছে? যাই হোক, ভিডিওটা দেখুন। ভালোভাবে দেখুন আর মুখস্ত করুন। আর কী বলব!’

আরেকটি স্ট্যাটাসে সাময়িক বরখাস্তকৃত এ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্দেশে লিখেন, ‘সাংবিধানিক ভিত্তিহীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, রিসেট বাটনে পুশ করা হয়েছে। অতীত মুছে গেছে। রিসেট বাটনে ক্লিক করে দেশের সব অতীত ইতিহাস মুছে ফেলেছেন তিনি। এতই সহজ। কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে আপনার, মহাশয়।’

আলোচনায় তার দুটি স্ট্যাটাসের বিষয়েই আলোকপাত করব। দ্বিতীয় স্ট্যাটাসের বিষয়ে আগে আসি।

একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাজ প্রজাতন্ত্রের নিয়মকানুনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা। তাদের রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ থাকা আবশ্যক, কিন্তু ঊর্মি তার মন্তব্যে সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ ও সরকারপ্রধানকে নিয়ে কটাক্ষ করেছেন।

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে কেউ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারে; সরকারবিরোধী মতও প্রকাশ করতে পারে, কিন্তু প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী হিসেবে ঊর্মির এ ধরনের মন্তব্য বিদ্রোহের শামিল।

নিয়ম অনুযায়ী, একজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী সরকারের সিদ্ধান্ত বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিব্রত করতে পারে, এমন কোনো ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না। ঊর্মির এ স্ট্যাটাস সরাসরি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবস্থান, যা তার দায়িত্বের পরিপন্থি।

ঊর্মি এ স্ট্যাটাসে ড. ইউনূসের রংপুর সফরে গাড়ি ব্যবহারের খরচ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এ ধরনের প্রশ্ন করা তার দায়িত্বজ্ঞানের অভাবে হতে পারে। সরকার প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের যে সুবিধা দেয়, সেগুলো নিয়েই তারা তাদের কাজ করেন।

এ ধরনের কার্যকলাপের পর তাকে শুরুতে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

এখন আসি ঊর্মির প্রথম স্ট্যাটাসের বিষয়ে, যেখানে তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত একজন ছাত্রকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে পুলিশের মারমুখী ভূমিকা বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উপেক্ষা করে তাদের ‘নিরীহ’ বলে উল্লেখ করেছেন।

তার এই মন্তব্য শুধু তার ব্যক্তিগত মতাদর্শের প্রকাশ নয়, বরং সমাজের একটি অংশের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলনও বলা যায়। এ ধরনের মন্তব্য বিশ্লেষণ করলে ঊর্মির মতাদর্শিক সংকীর্ণতা ও দৃশ্যত মানসিক বিকারকে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়, যা আমাদের সমাজের গভীরতর সমস্যার ইঙ্গিতবাহী। কেন গভীরতর সমস্যা বলছি, তার ব্যাখ্যা নিচে দিচ্ছি।

প্রথমত, ঊর্মির মন্তব্যগুলোতে তার মতাদর্শিক পক্ষপাত বেশ স্পষ্ট। কোনো আন্দোলন বা সংগ্রামে শহীদ হওয়া ব্যক্তি যদি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বা সামাজিক দাবির প্রতীক হন, তাহলে সেই ত্যাগকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যা দেয়া শিষ্টাচারবহির্ভূত ও কাণ্ডজ্ঞানহীন বলা চলে। এ ধরনের বক্তব্য বিপুল জনগোষ্ঠীর কাছে অত্যন্ত আপত্তিকর হিসেবে বিবেচিত হয়।

কোনো সন্ত্রাসী দেশ বা জাতির প্রয়োজনে বুলেটের সামনে বুক পেতে দেয় না, কিন্তু আবু সাঈদ সে কাজটিই করেছেন।

কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হলে এবং তার বিরুদ্ধে কোনো সন্ত্রাসী কার্যকলাপের প্রমাণ না থাকলে, তাকে ‘সন্ত্রাসী’ বলাটা পক্ষপাতিত্বের সুস্পষ্ট লক্ষণ। এতে বোঝা যায়, ঊর্মি তার দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি নির্দিষ্ট আন্দোলন বা গোষ্ঠীকে ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে দেখছেন এবং তাদের হত্যাকেও ন্যায়সঙ্গত মনে করেছেন। প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মকর্তার পক্ষ থেকে এ ধরনের বক্তব্য সামাজিক স্থিতির জন্য হুমকি হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ঊর্মির মন্তব্যও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পুলিশের হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা দেশবিদেশে বারবার আলোচিত হলেও ঊর্মি তাদের ‘নিরীহ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

ছাত্রজনতার এ অভ্যুত্থানে অনেক আন্দোলনকারী রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহিংসতার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, কিন্তু ঊর্মি পুলিশের প্রতি অন্ধ আনুগত্য দেখিয়েছেন, যা তার বিচারবোধ ও দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মকর্তার কাজ কোনো নির্দিষ্ট পক্ষ না নিয়ে নিরপেক্ষভাবে কাজ করা, কিন্তু ঊর্মির বক্তব্য শুধু মতাদর্শিক সংকীর্ণতার ইঙ্গিত দেয় না, এটি তার বিচারক্ষমতার দুর্বলতাকেও প্রতিফলিত করে।

প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মকর্তা হিসেবে তার দায়িত্ব ছিল সঠিক তদন্তের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে মতামত প্রদান করা, কিন্তু তার বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তিনি পক্ষপাতিত্বের শিকার।

তার এ মন্তব্য প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও সরকারের প্রতি জনআস্থার ওপর আঘাতের শামিল। প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা তখনই তৈরি হয়, যখন সেখানকার কর্মকর্তারা তাদের কাজের মাধ্যমে ন্যায়বিচারের নীতি অনুসরণ করেন।

ফেসবুকে তাপসী তাবাস্সুম ঊর্মির প্রতিক্রিয়া শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি বৃহত্তর সামাজিক সমস্যা নির্দেশ করে, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। একজন শহীদকে ‘সন্ত্রাসী’ এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ভূমিকা ‘নিরীহ’ বলে অভিহিত করা আমাদের সমাজের নৈতিকতার ওপর গভীর আঘাতের শামিল।

প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকে আমরা যে নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করি, তা তার এ মন্তব্যে অনুপস্থিত।

সবশেষে বলা যায়, ঊর্মির মন্তব্য শুধু তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত নয়, বরং সমাজের একটি অংশের মতাদর্শিক সংকটের প্রতিফলন।

প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের উচিত ব্যক্তিগত মতাদর্শকে আড়ালে রেখে নিরপেক্ষভাবে কাজ করা, কিন্তু ঊর্মির মতাদর্শিক ও দৃশ্যত মনস্তাত্ত্বিক বিকার তার দায়িত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার এ মন্তব্য আমাদের সমাজে বিদ্যমান নৈতিকতার সংকটের জাজ্বল্যমান উদাহরণ।

লেখক: নিউজ এডিটর ও অনলাইন ইনচার্জ, দীপ্ত টেলিভিশন

 

আরও পড়ুন

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More

সম্পাদক: এস এম আকাশ

স্বত্ব © ২০২৩ কাজী মিডিয়া লিমিটেড

Designed and Developed by Nusratech Pte Ltd.