বৃহস্পতিবার, ১৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১লা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৪ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
বৃহস্পতিবার, ১৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১লা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৪ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

উত্তরবঙ্গের বন্যা ও উপেক্ষার বাস্তবতা

দীপ্ত নিউজ ডেস্ক
10 minutes read

মাসউদ বিন আব্দুর রাজ্জাক

উত্তরবঙ্গে সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। প্রতি বছরের মতো এবারের বন্যায় হাজারো পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়ে খাবার, বিশুদ্ধ পানি এবং নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সংগ্রাম করছে। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট এবং রংপুর জেলার বেশ কিছু এলাকা এখন পানির নিচে।

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ৭ ইউনিয়নের ওপর দিয়ে তিস্তা নদী প্রবাহিত হচ্ছে। এই ৭টি ইউনিয়ন হলো: কাপাশিয়া, বেলকা, হরিপুর, তারাপুর, কঞ্চিবাড়ীর একাংশ এবং শ্রীপুর। পানি বিপৎসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, যার ফলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি।

গাইবান্ধার সদর উপজেলা কামারজানি ইউনিয়ন এবং সাঘাটাফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চল এখন পানির নিচে। কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর ও চিলমারির কয়েকটি ইউনিয়নও প্লাবিত হয়েছে। উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়ন ও বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের বিভিন্ন চরাঞ্চল বন্যায় তলিয়ে গেছে। রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের চর গতিয়াশাম ও খিতাবখাঁ গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিদ্যানন্দ এবং ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে তিস্তার ভাঙন ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।

লালমনিরহাট জেলায় তিস্তার পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় সদর উপজেলার গোকুন্ডা, রাজপুর, খুনিয়াগাছ, আদিতমারীর মহিষখোঁচা, কালীগঞ্জের ভোটমারী, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, সিংগীমারী, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া এবং ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের গ্রামগুলো প্লাবিত হয়েছে।

রংপুরে তিস্তা নদীর পানি বর্তমানে তিস্তা রেললাইনের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

নীলফামারী জেলায় তিস্তার পানি বাড়ার কারণে ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, পশ্চিম ছাতনাই, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাপানী, ঝুনাগাছ চাপানী, গয়াবাড়ি এবং খগাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের তিস্তা নদী বেষ্টিত ১৫টি চর গ্রামের পাঁচ হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

উত্তরাঞ্চলের বন্যার এমন ভয়াবহ প্রকোপে যে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে, তা সরকার, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। অথচ কিছুদিন আগে দক্ষিণপূর্বাঞ্চলের (কুমিল্লাফেনীনোয়াখালীচট্টগ্রাম) বন্যায় যেভাবে সরকার, প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষ সম্মিলিতভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, উত্তরবঙ্গে সে ধরনের উদ্যোগ কিংবা মনোযোগের অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

এখন প্রশ্ন ওঠে—কেন উত্তরবঙ্গের এই ভয়াবহ বিপর্যয় জাতীয় পরিসরে যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না? এর একটি বড় কারণ হতে পারে রাজধানী কেন্দ্রিক মনোযোগ এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলের প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি। প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে সমস্যাগুলো প্রায়শই অবহেলিত থেকে যায়, যা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অসম আচরণের জন্ম দেয়। মিডিয়া কাভারেজের ক্ষেত্রেও এই প্রবণতা স্পষ্ট। এখানে শুধু সরকারের নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরের মনোভাব ও মূল্যবোধের পরিবর্তন জরুরি।

এটি আমাদের সমাজের একটি বৃহত্তর অসঙ্গতি—প্রান্তিক জনগণের প্রতি অবহেলা এবং সহানুভূতির অভাব। বিভিন্ন ফাউন্ডেশন, ত্রাণ সংস্থা এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর নির্দিষ্ট কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। অন্যান্য অঞ্চলে যে সমন্বিত প্রচেষ্টা দেখা যায়, তা কেন উত্তরবঙ্গে অনুপস্থিত? এটি কি কেবল অনিচ্ছাকৃত অবহেলা, নাকি আমাদের সমাজের অদৃশ্য বৈষম্যের একটি প্রকাশ?

সীমাহীন উন্নয়ন বৈষম্য এবং নজিরবিহীন বঞ্চনায় উত্তরবঙ্গের মানুষের জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। এসব সমস্যা স্থায়ী সমাধানে সরকারের অবহেলার চিত্র স্পষ্ট। এ অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার ক্রমবর্ধমান; বর্তমানে কুড়িগ্রামের দারিদ্র্যের হার ৭০ শতাংশের উপরে। দেশের দরিদ্রতম ১০ জেলার ৫টি রংপুর বিভাগে অবস্থিত। রংপুর বিভাগের দারিদ্র্যের হার ২৪.%, যা জাতীয় দারিদ্র্যের হারের চেয়ে ৬.৯ শতাংশ বেশি।

ফলে এ অঞ্চলের মানুষ পেশা পরিবর্তন করে দেশের অন্যান্য প্রান্তে জীবিকার অন্বেষায় সস্তা শ্রমের মাধ্যমে পরিণত হচ্ছে। রংপুর অঞ্চল কি তাহলে বাংলা মায়ের সতীন? রংপুর বিভাগ দেশের খাদ্য চাহিদার ৫০ শতাংশ এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পের কাঁচামালের ৭০ শতাংশের যোগানদাতা। অথচ এ অঞ্চলের জনগণের সার্বিক জীবনমান উন্নয়ন এবং বহুমাত্রিক দারিদ্র্য নিসরণের জন্য সরকারের দৃশ্যমান কোনো প্রকল্প নেই। রংপুর বিভাগের বিরাজমান দারিদ্র্য পরিস্থিতির যথাযথ মূল্যায়ন এবং দারিদ্র্য নিরসনে টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের জোরালো তৎপরতার অভাব স্পষ্ট।

এমনকি সুশীল সমাজ এবং মিডিয়ার ভূমিকা এখানে প্রশ্নবিদ্ধ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা প্রসঙ্গে যেভাবে আলোচনা হয়, উত্তরবঙ্গের এই সংকট নিয়ে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। মিডিয়ায় দক্ষিণপূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির নানা খবর উঠে আসলেও উত্তরবঙ্গের বন্যা নিয়ে প্রয়োজনীয় কাভারেজ এখনো প্রায় অনুপস্থিত।

উত্তরবঙ্গের ৫টি জেলায় প্রায় ৫০ হাজার পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। স্থানীয় জনগণ এবং কিছু ছোট ছোট সংগঠন নিজেদের উদ্যোগ নিয়ে সহায়তা কার্যক্রম চালালেও এই ভয়াবহ সংকট মোকাবিলায় জাতীয় পর্যায়ে বড় ধরনের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। শুধুমাত্র স্থানীয় পর্যায়ের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়; সমন্বিত ত্রাণ কার্যক্রম ও পুনর্বাসন এখন অপরিহার্য।

এখনই সময় আমাদের এই বৈষম্য দূর করার জন্য একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে। সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে এবং মিডিয়াকে তার দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে এই দুর্যোগকে জাতীয় আলোচনায় নিয়ে আসতে হবে। লোক দেখানো সহানুভূতির বদলে কার্যকরী পদক্ষেপ ও সার্বিক সহায়তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।

প্রান্তিক জনগণের জন্য সমান অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের সমগ্র সমাজকে আরও সচেতন এবং দায়িত্বশীল হতে হবে। নতুবা এই বৈষম্য আমাদের রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও সামাজিক বন্ধনকে দুর্বল করে তুলবে।

উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতির প্রধান অন্তরায় বছরে দুবার বন্যা। তাই পিছিয়ে পড়া উত্তরাঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীগুলোর সার্বিক উন্নয়নকল্পে সরকারকে অগ্রবর্তী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। বন্যা প্রতিরোধে টেকসই নদীশাসন, তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন, অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টনে সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তিস্তাপাড়ে বহুমুখী শিল্প স্থাপন করে রংপুর বিভাগের মানুষকে দেশের অর্থনীতির মূলস্রোতের সঙ্গে একীভূত করতে হবে।

লেখক: নিউজ এডিটর ও অনলাইন ইনচার্জ, দীপ্ত টেলিভিশন

আরও পড়ুন

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More

সম্পাদক: এস এম আকাশ

স্বত্ব © ২০২৩ কাজী মিডিয়া লিমিটেড

Designed and Developed by Nusratech Pte Ltd.