আজ ২৫ এপ্রিল নওগাঁর রাণীনগরবাসীর জন্য বিভীষিকাময় একটি দিন। এই দিনে নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার আতাইকুলা পালপাড়ায় নারকীয় গণ্যহত্যা চালিয়েছিলো পাক–বাহিনীরা। তাই এই দিনটি আসলে এখনও গা শিউরে উঠে ওই এলাকার বাসিন্দাদের।
লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশের কোটি কোটি মানুষের বিজয় হওয়ার পর ৫১টি বছর চলে গেছে। কিন্তু কেমন আছেন আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামের সেই ৫২ জন শহীদেরও বেঁচে যাওয়া মানুষদের পরিবার? তাদের আজও মেলেনি মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, বাস্তবায়ন হয়নি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আর অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে স্মৃতি বহনকারী বধ্যভূমিটি।
উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দক্ষিণ–পশ্চিমে ছোট যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত আতাইকুলা পালপাড়া গ্রাম। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল পাক–হানাদার বাহিনীরা স্থানীয় দোসর রাজাকার ও আলবদরদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত নির্যাতন চালায় এই পালপাড়া গ্রামের সনাতন ধর্মের মানুষদের ওপর। শান্ত এ গ্রামটি সেদিন হয়ে উঠে নারকীয় হত্যাযজ্ঞে। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ৫২ জনকে।
সেদিনের সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শী প্রদ্যুৎ পাল। কামানের গুলি এক ফুট উপর দিয়ে যায় এই কথা শুনেছিলেন তিনি তার এক বন্ধুর কাছে। আর সেই এক ফুটের কথা মনে হওয়াতেই আজ বেঁচে আছেন তিনি। চোখের সামনে বাবা ভাইদেরসহ অন্যান্যদের একসাথে মৃত্যু দেখে একরকম অভিমান ও ক্ষোভ নিয়ে বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন প্রদ্যুৎ পাল। তিনি তেমন আর কথা বলতে চান না। তার ভাষ্য দীর্ঘ প্রায় ৫১ বছর ধরে এভাবে সেদিনের সেই নির্মম হত্যাকান্ডের কথা বলেই যাচ্ছেন। তাতে কি লাভ হচ্ছে? অনুরোধে তিনি সেই জায়গা দেখিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বর্ণনা করে বলতে লাগলেন, দিনটি ছিল রবিবার। সকাল ৯টায় ছোট যমুনা নদী পার হয়ে আসে একদল হানাদার বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা এই গ্রামে আছে বলে তারা সন্দেহ করে প্রথমে গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে। এরপর প্রতিটি বাড়ী থেকে বিভিন্ন বয়সীদের ধরে গ্রামের যোগেন্দ্র নাথ পালের বাড়ির বারান্দায় একত্রিত করে দুই ভাগে ভাগ করে সারিবদ্ধ করে। তারা ষ্টীম রোলার চালিয়ে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতনসহ জঘন্য ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এরপর তারা ব্রাশ ফায়ার করে ৫২ জন শান্তিপ্রিয় মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। সেদিন ৫২ শহীদের তাজা রক্তে নওগাঁর ছোট যমুনা নদীর পানি লাল হয়ে ভেসে যায়। এছাড়া পাক হানাদার বাহিনীদের গণহত্যা, লুটপাট ও ধ্বংসলীলা থেকে নারীরা স্বামী সন্তানদেরকে প্রাণে বাঁচানোর আকুতি করলেও মন গলাতে পারেনি তাদের। উল্টো পাক বাহিনীরা সুযোগ বুঝে নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।
৭৮ বছরের ধীরেন্দ্র নাথ পাল গুলির চিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছেন এখনও। কোন সুযোগ সুবিধা পেয়েছেন কিনা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, মারা গেলে পাইতাম! কেন এই কথা বলছেন জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বলেন, ঢাকায় আমাদের ডাকা হয়েছিল। সেখানে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে কোন একজন বলেছিলেন সেই কথা।
তারমতো আহতবস্থায় অভাব–অনটনের সংসারে আর বয়সের ভারে কোনমতে বেঁচে আছেন নিখিল পাল, গিরেন পাল, সাধন চন্দ্র পালসহ আরও অনেকেই। একাত্তরের সেই যন্ত্রণা ও অনেকটা দুঃখ–দুর্দশা, অভাব–অনটন আর অসুস্থতার মধ্যেই চলছে তাদের জীবন সংগ্রাম।
তবে নওগাঁ–নাটোর এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য শাহিন মনোয়ারা হক গত ১৯৯৮ সালের ২৫ এপ্রিল নিজ উদ্যোগে কিছু অনুদান দিয়ে স্মৃতি স্তম্ভের ফলক উন্মোচন করে কোন রকমে ফলকে শহীদদের নাম লিপিবদ্ধ করার কাজ সম্পন্ন করেন। এরপর আর কেউ খোঁজ রাখেনি, হয়নি কোন কাজ। তাই গণকবর বা বধ্যভূমিটি পরে আছে অযত্ন আর অবহেলায়। বর্তমানে গণকবরটির মধ্যে জন্ম নিয়েছে আগাছা। চারপাশ দিয়ে গোবাদি পশু চারন করা হয়। এছাড়া গণকবরটি শহীদ পরিবারের সদস্যরা নিজেদের উদ্দ্যোগে কোন রকমে ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রেখেছে মাত্র। গণকবর বা বধ্যভূমিতে যাওয়ার একমাত্র ইট বিছানো রাস্তাটিরও বেহাল দশা। এরপর ২০১৯ সালে স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামের শুধুমাত্র ১০ বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা সমমান মর্যাদা দেয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২০১৫ সালে সেই সকল ৫২ শহীদের নাম সরকারি গেজেটে অন্তর্ভুক্তি, শহীদের আত্মদান স্মরণে বধ্যভূমি সংরক্ষণ, স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের অর্থ বরাদ্দ ও শহীদদের অসহায় পরিবারকে মূল্যায়ন এবং আর্থিক সাহায্য প্রদানের নির্দেশনা প্রদান করা হয়। কিন্তু প্রায় সাত বছর পার হলেও প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নির্দেশনা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। তাই এই স্বাধীনতার স্বপক্ষের বর্তমান সরকারের কাছে প্রদ্যুৎ পালসহ স্থানীয়দের এখন কয়েকটি চাওয়া। তাদের দাবি এই গণকবর বা বধ্যভূমির স্থানটি প্রায় ৮শতকের উপর নির্মিত। এখানে একটি পর্যটন এলাকা গড়ে তোলা, যেখানে থাকবে লাইব্রেরি। থাকবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই। যেন নতুন প্রজন্ম জানতে পারে। প্রয়োজনে আরও জমি লিখে দিতে রাজি আছেন তারা। এবং বিশ^ বাঁধ থেকে বধ্যভূমিতে যাতায়াতের রাস্তাটি পাঁকাকরণ। এছাড়া নদী পারপারের জন্য একটি সেতু যেগুলো হবে শহীদদের নামে নামকরণ।
নতুন প্রজন্মের স্থানীয় তুলি পাল, স্বপন পালসহ অনেকেই বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের প্রতি সরকার সদয় হোক। আমাদের গ্রামের শহীদদের আত্মত্যাগের কথা ইতিহাসের পাতায় যেন স্থান পায়। দেশের মানুষের কাছে জ্ঞাত হোক তাদের আত্মত্যাগের কথা। বধ্যভূমিটি সংরক্ষন ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে আগামীর প্রজন্মের কাছে নতুন করে তুলে ধরতে ৫২ জন শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে সকল জটিলতার অবসান ঘটিয়ে দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর দেয়া নির্দেশনার বাস্তবায়ন চান শহীদ পরিবার ও স্থানীয়রা।
সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এ্যাড. ইসমাইল হোসেন বলেন, ২০১৫ সালে প্রধামন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ৫২জন শহীদের আত্মদান স্মরণে বধ্যভূমি সংরক্ষন, শহীদদের নাম সরকারি গেজেট অন্তর্ভূক্ত, স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের অর্থ বরাদ্দ ও শহীদদের অসহায় পরিবারকে মূল্যায়ন ও আর্থিক সাহায্য প্রদানের নির্দেশনা প্রদান করা হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত নির্দেশনাগুলোর একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। তারমধ্যে জামুকার ভুলের কারণে তাদের সাধারণ শহীদের স্বীকৃতির আলোর মুখ দেখেনি। এছাড়া এতোদিন জমি অধিগ্রহনের সমস্যার কারণে বধ্যভূমি সংরক্ষন ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। ভূমি অধিগ্রহণ হলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার একটি বধ্যভূমি সংরক্ষণ খুব দ্রুতই বাস্তবায়ন হবে বলেও জানান তিনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত হুসেইন বলেন, আমি ওই বধ্যভূমিটি পরিদর্শন করেছি। প্রদ্যুৎ পালসহ অনেকের সাথে কথা বলেছি। তাদের দাবির বিষয়ে আবেদন করলে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। এছাড়া শহীদদের অসহায় পরিবারকে সহযোগীতা দেয়ারও চেষ্টা করবো। আর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার বিষয়ে জেলা প্রশাসক স্যারের নির্দেশনা সাপেক্ষে এবং এই কাজে জড়িত সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেই বিষয়ে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করবো।
যূথী/দীপ্ত সংবাদ