বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘুরে শিক্ষকতা আর শিক্ষার্থী শব্দের মানে বোঝার চেষ্টা করলাম।
শিক্ষাদানের মহান ব্রত যার কাজ তাকেই, শিক্ষক বলা হয়।শিক্ষকদের জাতি গঠনের কারিগর বলা হয়। শিক্ষার্থীর মানবতাবোধ কে জাগ্রত করে একজন শিক্ষক কেবল পাঠদান কে সার্থকই করে তোলেন না, পাশাপাশি দেশের উন্নয়নকে ত্বরাণ্বিত করেন। নিজের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করে তাদেরকে দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলেন।
আর শিক্ষার্থীর (ছাত্র) শব্দের মূল অর্থ,”যে গুরুর দোষ ঢেকে রাখে।” যারা শিক্ষা অর্জন করে, জ্ঞান লাভ করে, কারো কাছ থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করে সেই শিক্ষার্থী-ছাত্র।
এবার আসি কেন এসব খুঁজছি, সেই বিষয়ে।
আমি নিজেও একজন শিক্ষার্থী। আমিও ক্লাশ ৯-এ পড়াশোনা করেছি। আমিও অরিত্রীর বয়সের ছিলাম। আমারো একটা স্কুল ছিল। আমারো অনেক শিক্ষক ছিল। প্রাইমারী স্কুল, হাই স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, সব পার করলাম। প্রত্যেকটা পদক্ষেপেই শিক্ষক ছিলো আমারও। সবারই থাকে। শিক্ষক ছাড়া আমরা কেউই শুধুমাত্র পরিবার থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান নিয়েই বড় হইনি। তাই শিক্ষক এবং অরিত্রীর মতো কমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রতি সম্মান ও ভালোবাস রেখেই কথাগুলো বলছি।
অরিত্রীর আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে পত্র পত্রিকা, সামাজিক মাধ্যমগুলোতে লেখার ফুলঝুড়ি রচনা হচ্ছে। শিক্ষকের দোষ। কেন একজন শিক্ষার্থীকে এতো অপমান করা হলো। যার ধরুণ সে আত্মহত্যা করেছে। শিক্ষকের এমন আচরন মেনে নেয়া যায় না। শিক্ষক বহিস্কার। ব্লা ব্লা ব্লা। কত কথা। কত বিতর্ক।
১
অরিত্রী যদি আজ আত্মহত্যা না করত, তার মৃত্যর পর যেই সহপাঠিরা-শিক্ষার্থীরা রাস্তায় দাড়িয়েছে, তারাই ক্লাশে কিংবা ক্যাম্পাসে অরিত্রীর দিকে আঙুল উচিয়ে বলত না, “ওই যে মেয়েটা, পরীক্ষায় নকল করেছিল, তার বাবা-মাকে স্কুলে ডেকে আনা হয়েছিল, ওকে টিসি দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। ইত্যাদি ইত্যাদি” এই নিশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারবেন? সে যে সহপাঠিদের দ্বারা অপমানিত হতো না, কিংবা সে শিক্ষক ছাড়াও অন্য কারো কাছ থেকে অপমানিত হয়নি, এমন নিশ্চয়তাও কি কেউ দিতে পারবেন? কেউ কি বলতে পারবেন, অরিত্রীর বাবা-মা অরিত্রীকে কোনো ধরনের কড়া কথা-অপমানজনক কথা বলেননি।
আমার স্কুলে রোল নং পেছোলে আমার বাবা-মা কত বকা দিতেন। বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলতেন। এমন সন্তান দরকার নেই বলতেন। সেখানে অরিত্রীকে এমন কড়া কথা বাবা-মা কারো কাছ থেকে শুনতে হয়নি, এমনটা কী কেউ জানি! তাহলে আত্মহত্যার জন্য কে দায়ী?
২
স্কুলে শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেবেন, বুদ্ধি দেবেন, ধমক দেবেন, শাসন করবেন। সবকিছুর মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন। আমাদের শিক্ষকেরা আমাদের বেত দিয়ে মারতেন। সেই বেত তো অনেক আগেই উঠে গেছে। স্কুলের মাঠে স্যারদের দেখলে বারান্দায় দাড়ানোর সাহস পেতাম না। এখনো হাই স্কুলের গেটে পা রাখলে কেমন যেন অনুভূতি হয়। কী মনে হচ্ছে? স্যাররা আমাদের শুধুই মারতেন? না । আদর করতেন। ভালোবাসতেন। পরামর্শ দিতেন। শাসন করতেন। কড়া কথা বলতেন। কখনো সেগুলোকে অপমান মনে হয়নি। সংশোধনের জন্য পরামর্শ-দিক নির্দেশনা মনে হয়েছে। আমাদের শিক্ষকেরা আমাদের তুই করে ডাকতেন। এই তুইয়ের মধ্যে যে মায়া আছে না, সব বকা-শাসন-অপমানের অধিকার নিয়ে নেয়। এই অপমান জাতীয় শব্দগুলো আর থাকে না শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে। এখন তো তুই করে বলাটা অনেকে নিতেই পারে না। তার ওপর শিক্ষকদের মুখের ওপর কথা বলাটা আজ কালকার শিক্ষার্থীরা এক ধরনের আধুনিকতা মনে করে। পারলে শিক্ষকদের ওপর চড়াও হয়। আমার বাবাসহ অনেককেই দেখেছি, স্কুলের-কলেজের শিক্ষকদের বলতেন, “আপনার কথা না শুনলে, পড়াশোনা ঠিকমতো না করলে, হাড্ডিটা ফেরত দিলেই হবে। আপনার প্রয়োজন হলে শরীর থেকে মাংস ছাড়িয়ে ফেলবেন।” আমরা এখনো বেঁচে আছি। তার মানে, শিক্ষকরা মাংস ছাড়াও করেনি, পিটিয়ে লাশ ও বানায়নি। আমাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে শিক্ষকেরা যে সহযোগিতা পেতেন, তাতে শিক্ষক নিজের মতো করে ছাত্রদের মানুষ বানাতে পেড়েছে। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন বাবা-মায়ের চাহিদা পরিবর্তণ হয়েছে। তারা অনেক আদর করে সন্তানকে বড় করেন। কোনো দিন তাদের গায়ে হাত তুলেন না। কড়া কথা বলেন না। তাদের কোনো আবদার ফেলেন না। সেই সন্তানকে একজন স্কুল শিক্ষক, যিনি কিনা পরিবারের বাইরের একজন মানুষ, সে কেন কিছু বলবে। তার এত বড়ো সাহস হলো কোত্থেকে!
৩
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নীতিমালা, বিধি-নিষেধ রয়েছে। সেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি কর্মী থেকে শুরু করে সবাইকে সেই নীতিমালা মেনে চলতে হয়। তার বাইরে যে যাই করুক, সেটি বেআইনি অথবা আইন অমান্য অথবা নীতিমালা পরিপন্থি কাজ বলে গণ্য করা হয়। তেমনি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েরও থাকে। নিজস্ব নীতিমালার বাইরে গেলে কোথাওই কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সুন্দর সুন্দর মিষ্টি কথা শোনা যায় না। যা বলে, সব সহ্য করতে হয়। আমরা মুখ বুছে সহ্য করি। তাতে আমাদের যত কঠিন কথাই বলা হোক। কারণ আমরা প্রতিষ্ঠানের প্রচলিত নীতির বাইরে কাজ করেছি। সে কারণে যদি আমাদের ওই প্রতিষ্ঠানে থাকতে ইচ্ছে করে, সুন্দরভাবে নিজের ভুল স্বীকার করে, ক্ষমা চেয়ে আমরা থাকি। অথবা যদি নিজের প্রচুর ব্যক্তিত্ব থেকে থাকে/ নিজের ভুলকে ভুল বলে মনে না করে থাকি/ নিজেকে অনেক বড় কিছু মনে করি, তাহলে আমরা প্রতিষ্ঠানকে পাত্তা না দিয়ে সেখান থেকে চলে যাই। এই তো আমাদের রোজকার ঘটনা।
৪
আমার জানা মতে (ভুল হতে পারে) ঢাকায় অধিকাংশ ভালো স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের মোবাইল নেয়া নিষিদ্ধ। তাহলে সেখানে একজন শিক্ষার্থী কীভাবে স্কুলে মোবাইল নিয়ে আসে। সেখানে নকল থাকুক আর না থাকুক। আর সেই মোবাইলটা আমরা পেলাম কীভাবে। আমাদের বাবা-মা, তারাই কিনে দিয়েছেন নিশ্চয়ই। এখন কাকে কি জন্য দোষ দেবো?যে মোবাইল ব্যবহার করল তাকে। নাকি যিনি কিনে দিয়েছেন। নাকি নীতি ভঙ্গের জন্য? নাকি শিক্ষককে? যিনি নিয়ম বুঝিয়েছেন। যিনি পড়িয়েছেন। যিনি শিক্ষা দিয়েছেন। কাকে?
বাবা-মা কি এমনিতেই একজন শিক্ষার্থীকে একটি স্মার্টফোন কিনে দেয়? একটা বাইক কিনে দেয়। আমরা অনেক সময় বাবা-মায়ের দোষ দেই। সব কিছু দিয়ে সন্তানকে মাথায় তুলেছে। কিন্তু, মোবাইল না দেওয়ায়, বাইক না দেওয়ায়, ওই সন্তান দরজা বন্ধ করে ৩দিন না খেয়ে, স্কুলে না যেয়ে কাটায়নি, তার কী নিশ্য়তা আছে। বাবা-মা চোখের সামনে সন্তানকে মরতে তো দেখতে চাবে না। তার চেয়ে থাক বাবা তুই মোবাইল নিয়ে, বাইক নিয়ে। তবুও বেঁচে থাক।
৫
আজ যদি অরিত্রী আত্মগত্যা না করত, শিক্ষক কতটুকু অপমান করেছে, কেন করেছে, এই প্রশ্নগুলো হয়তো কেউই করতো না। যদি ওই শিক্ষক জানতেন আমার শিক্ষার্থী আমার কথায় কষ্ট পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে যাচ্ছে, কোনোদিনই তিনি ওরকম করে কথা বলতেন না। কোনো বাবা-মা যেমন চান না তার সন্তান মারা যাক। নষ্ট হোক, খারাপ হোক, কষ্ট পাক, তবুও বেঁচে থাকুক। ঠিক তেমনই শিক্ষকেরাও চায়, তার ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে মানুষের মতো মানুষ হয়। স্কুল-কলেজের গেইটে লেখা থাকে ‘শিক্ষার জন্য এসো, সেবার জন্য বেরিয়ে যাও’। বিশ্বাস করুন কোনো শিক্ষক চায় না, তার শিক্ষার্থীরা লাশ হয়ে বের হয়ে যাক। আমাদের শিক্ষকেরা আমাদের ওপর অধিকার খাটিয়ে কড়া কথা বলে। অধিকার নিয়ে অপমান করে। অধিকারের বলে আমাদের শাসন করে। বলা হয় শিক্ষার্থী শিক্ষকের মানস সন্তান। সন্তানের ওপর কোন বাবা-মায়ের অধিকার থাকে না বলেন!
৬
শহরের নামি দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অত্যাচার একটু বেশিই মনে হয়! ভুক্তভোগিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা মনে করেন, ”আমাদের প্রতিষ্ঠান সেরা প্রতিষ্ঠান। একমাত্র আমরাই প্রকৃত শিক্ষা দিয়ে থাকি। শুধু আমরাই মানুষ বানাতে পারি। তাই যতকিছুই হোক বাবা-মায়েরা আমাদের কাছেই আসবে “। তাদের চোখে কোনো বাবা-মা শিক্ষার কিচ্ছু বোঝে না, তাদের কোনো জ্ঞান নেই। আসলেই তো নেই। দেখবেন, যত কিছুই ঘটুক নামি দামি স্কুলের ভর্তি পরীক্ষার দিন গেটের বাইরে কী পরীমান শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের ভীড়। যে স্কুলের শিক্ষার্থী অরিত্রী, যে স্কুল সম্পর্কে অনেকেই কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলছেন। যে সব শিক্ষকদের বিরুদ্ধে উক্তি আওড়াচ্ছেন, তাদের সন্তানকে ওরকম আরেকটা স্কুলে পড়ানোর জন্য, ওই রকম আরেকটা শিক্ষকের কাছে শিক্ষা গ্রহণের জন্য, শুক্রবারের সকালের ঘুম নষ্ট করে ভোর ৬টায় স্কুলের গেটে দাড়িয়ে থাকছেন না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?
একটা ক্লাস ওয়ানের বাচ্চার ওজনের থেকে তার স্কুল ব্যাগের ওজন বেশি। তার মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয় জিপিএ ৫ পেতে হবে। এক একটা বাচ্চাকে রোবট বানানো হচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে ব্যাগ নিয়ে ছোটো। আর বাসায় এসে ঘুমাতে যাও। ভবিষ্যতটাকে ঘুমের রাজ্যে দিয়ে দিচ্ছি আমরা। আসুন না চিন্তা ধারা বদলাই।
৭
কখনোই কোনো কিছুর অতিরিক্ত ভালো না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কঠিন নিয়ম অনেক সময় আমাদের শিক্ষকদের অধিক খারাপ ব্যবহার করতে বাধ্য করে। অনেক শিক্ষক আবার এমনিতেই ভীষন কড়া। শিক্ষকরা যদি বন্ধুসূলভ হতো। শিক্ষকরা যদি সহযোগী হতো। শিক্ষকরা যদি লিডারের মতো হতো। আমরা অনেক প্রাণ হয়তো বাঁচাতে পারতাম। অনেককে সঠিক পথে আনতে পারতাম। তবুও দিন শেষে শিক্ষক শিক্ষকের জায়গাতেই। কখনো হত্যাকারীর জায়গায় থাকার কথা না। তেমনি একজন শিক্ষার্থীর মানসিকতারও প্রসার দরকার। শিক্ষকের অপমান-অপদস্তকে প্রাণনাশক টনিক হিসেবে ব্যবহার না করে শোধরানোর টনিক হিসেবে নেয়াই ভালো।
আমরা অনেক ভালো মন্দ বিচার করতে পারি। অরিত্রীর একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য, শিক্ষকদের ধুয়ে দিচ্ছি। অরিত্রী যদি বুঝতে পারতো, তার আত্মহত্যার জন্য তারই শিক্ষকদের এমন পরিস্থিতি হবে, নিশ্চয়ই সে এই কাজ করতো না। কারো একক দোষে অরিত্রীরা মরে না। সমাজের দোষে, শিক্ষা ব্যবস্থার দোষে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দোষে, আমাদের দোষে, চিন্তা ভাবনার দোষে, ভালো কিছু না ভাবতে পারার দোষে, ধৈর্য্য না ধরার দোষে, মানসিকভাবে স্থূল হয়ে যাওয়া দোষে আস্তে আস্তে অরিত্রীরা পৃথিবী থেকে ঝড়ে যায়।
আমরা যারা শুধু শিক্ষকদের সংযত হতে বলছি। দেখবেন, ন্যায় নীতির গ্যারাকলে ফেলে, শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের কোনো ধমক দিতে পারবেন না, শাসন করতে পারবেন না, এমন কিছু না করে ফেলি। শিক্ষকদের কাজ যেন শুধু পাঠদান না করে ফেলি। তারাই কিন্তু মানুষ গড়ার কারিগর। আমরা যদি এমন করি, খুব বিপদ হয়ে যাবে। যদি শিক্ষকেরা হাল ছেড়ে দিয়ে বলে, গোল্লায় যাক বাবা তোর সন্তান আমার তাতে কী! কী হবে?
১০ ডিসেম্ভর ২০১৮। রাত ১১টা। পশ্চিম নাখালপাড়া, তেজগাঁও, ঢাকা, বাংলাদেশ- ১২১৫।