বিজ্ঞাপন
সোমবার, মার্চ ১০, ২০২৫
সোমবার, মার্চ ১০, ২০২৫

৫২৭ বছরের ঐতিহ্যবাহী সুলতানি আমলের কুসুম্বা মসজিদ

Avatar photoদীপ্ত নিউজ ডেস্ক

উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী কৃষি নির্ভর বরেন্দ্র জেলা নওগাঁ। এ জেলায় রয়েছে প্রায় ৫২৭ বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘কুসুম্বা মসজিদ’। স্থাপত্যশৈলী ও নন্দনতাত্ত্বিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে দেশের ৫ টাকার নোটে কুসুম্বা মসজিদের ছবি ছাপানো হয়েছে। যা সকলের দৃষ্টি কেড়েছে।

বাংলাদেশে সুলতানি আমলের যত নিদর্শন আছে, তার মধ্যে অন্যতম নওগাঁর কুসুম্বা মসজিদ। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় অনুযায়ী, ৫২৭ বছরের ঐতিহ্য ধারন করে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটি। নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে মান্দা উপজেলার কুসুম্বা ইউনিয়নের কুসুম্বা গ্রামে অবস্থিত কুসুম্বা মসজিদ। রাজশাহী মহাসড়কের মান্দা ব্রিজের পশ্চিম দিকে ৪০০ মিটার উত্তরে কুসুম্বা মসজিদটির অবস্থান। প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী আসেন এই মসজিদটি একনজর দেখার জন্য। মসজিদটির উত্তরদক্ষিণ দিকে রয়েছে প্রায় ১০০ বিঘার বিশাল দিঘী। এটি লম্বায় প্রায় ১২০০ ফুট ও চওড়ায় প্রায় ৯০০ ফুট। গ্রামবাসী এবং মুসল্লিদের খাবার পানি, গোসল ও অজুর প্রয়োজন মেটানোর জন্য এই দিঘীটি খনন করা হয়।

কুসুম্বা মসজিদ​_টি উত্তরদক্ষিণে ৫৮ ফুট লম্বা, ৪২ ফুট চওড়া। চারদিকের দেয়াল ৬ ফুট পুরু। তার ওপর বাইরের অংশ পাথর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। মসজিদের সামনের অংশে রয়েছে তিনটি দরজা। আকারে দুটি বড়, অন্যটি অপেক্ষাকৃত ছোট। দরজাগুলো খিলানযুক্ত মেহরাব আকৃতির। মসজিদের চার কোনায় রয়েছে চারটি মিনার। মিনারগুলো মসজিদের দেয়াল পর্যন্ত উঁচু ও আট কোনাকার। ছাদের ওপর রয়েছে ছয়টি গম্বুজ। যা দুটি সারিতে তৈরি।

কুসুম্বা মসজিদের দ্বিতীয় সারির গম্বুজগুলো আকৃতির দিক দিয়ে ছোট। ১৮৯৭ সালের এক ভূমিকম্পে তিনটি গম্বুজ নষ্ট হয়েছিল। পরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটি সংস্কার করে। মসজিদের ভেতর দুটি পিলার রয়েছে। উত্তর দিকের মেহরাবের সামনে পাথরের পিলারের ওপর তৈরি করা হয়েছিল একটি দোতলা ঘর। এই ঘরটিকে বলা হতো জেনানা গ্যালারি বা মহিলাদের নামাজের ঘর। সেখানে মহিলারা নামাজ পড়তেন।

মসজিদের ভেতর পশ্চিমের দেয়ালে রয়েছে তিনটি চমৎকার মেহরাবের ওপর ঝুলন্ত শিকল, ফুল ও লতাপাতার কারুকাজ করা। এ কারুকার্যগুলো খুব উন্নতমানের। দক্ষিণ দিকের মেহরাব দুটি আকারে বড়। উত্তর দিকের মেহরাবটি ছোট। মসজিদটির উত্তরদক্ষিণ দিকে দুটি করে দরজা। মসজিদের সম্মুখভাগে রয়েছে খোলা প্রাঙ্গণ ও পাথর বসানো সিঁড়ি, যা দিঘীতে গিয়ে নেমেছে। মসজিদের প্রবেশ পথের একটু দূরে বাক্স আকৃতির একখণ্ড কালো পাথর দেখা যায়। ধারণা করা হয়, এটি একটি কবর।

কথিত আছে, সবরখান বা সোলায়মান নামে ধর্মান্তরিত এক মুসলমান মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের দুটি শিলালিপির তারিখ প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। তবে মূল প্রবেশ পথে শিলালিপি থেকে প্রমাণিত হয়, এই মসজিদটি ১৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি। শেরশাহের বংশধর আফগান সুলতান প্রথম গিয়াস উদ্দীন বাহাদুরের শাসনামলে (১৫৫৪১৫৬০ খ্রীষ্টাব্দ) নির্মিত। সে হিসাবে মসজিদটির বর্তমান বয়স ৪৬৭ বছর। অপর শিলালিপি অনুযায়ী সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের আমলে তার মন্ত্রী বা প্রশাসনিক কর্মকর্তা ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দ মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সে হিসেবে মসজিদটির বয়স এখন ৫২৭ বছর।

কুসুম্বা গ্রামটির নামকরণ নিয়ে নানা জনশ্রুতি রয়েছে। গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহর বেগম কুসুম বিবি কিছুদিন এ অঞ্চলে এসে বসবাস করেন। তাঁর নামানুসারে গ্রামটির নামকরণ হয় কুসুম্বা। পরে কুসুম বিবির নামানুসারে মসজিদ নির্মিত হয়। তবে এর কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা নেই বলে মনে করেন ইতিহাসবিদেরা।

কুসুম্বা মসজিদটি চারকোনা বিশিষ্ট। কালো ও ধূসর রঙের পাথর আর পোড়ামাটির ইটে গড়া এই মসজিদ।

ব্যবহার করা হয়েছে মাটির টালি। ইটের তৈরি দেয়ালের বাইরে ও ভেতরের দিক পাথরে আবৃত। মসজিদের চার কোনায় চারটি আটকোনাকৃতির বুরুজ (মিনার) আছে। এর ভেতরে রয়েছে দুটি প্রশস্ত স্তম্ভ।

মসজিদে ঘুরতে আসা আরিফুল হক রণক ও সোহেল রানা বলেন, পাঁচ টাকার নোটে ছবি দেখে অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল এখানে বেড়াতে আসার। চারপাশের পরিবেশ অনেক সুন্দর। এখানে এসে খুব ভালো লাগছে। তবে যদি এখানে একটি রেস্ট হাউস নির্মাণ করা হয় তাহলে ঘুরতে আসা দূর দূরান্তের দর্শনার্থীদের জন্য সুবিধা হবে।

স্থানীয়রা জানান, মসজিদটিতে দূরদূরান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে আসেন।

এছাড়া রাজশাহী, ব্রাক্ষণবাড়ীয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও আসেন দর্শনার্থীরা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা দর্শনার্থী সালমান ও কুমকুম বলেন, এত সুন্দর দৃষ্টিনন্দন ও অপরূপ মসজিদ কখনও দেখিনি। আগে যা দেখেছিলাম তার থেকে এখন আরো বেশি সুন্দর মসজিদটি। বার বার আসতে ইচ্ছে করে। তাই আসি। সামনে রয়েছে বিশাল দিঘী। এসব দেখতে প্রতিদিনই ছুটে আসেন শত শত নারীপুরুষ।

কুসুম্বা মসজিদের মুয়াজ্জিন মাওলানা ইসরাফিল আলম বলেন, প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ আসেন কুসুম্বা মসজিদ ঘুরে দেখতে। এখানে এসে অনেকেই নামাজ আদায় করেন। তবে শুক্রবার জুমার সময় বেশি মুসল্লির আগমন ঘটে। মসজিদের ভেতরে চারটি কাতারে প্রায় ৮০জন মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন।

এছাড়া মসজিদের সামনের অংশে খোলা স্থানে প্রায় ৭০০ মুসল্লি জামায়াতে নামাজ আদায় করতে পারেন। প্রতি শুক্রবার ও বছরে দুই ঈদের জামাতে মসজিদের ভেতর ও বাইরের পুরো চত্বর মুসল্লিতে ভরে যায়। এছাড়া পবিত্র রমজানে তারাবিহর নামাজও পড়া হয় এখানে।

কুসুম্বা মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা ওবায়দুল হক বলেন, সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন এবং সুলতান গিয়াস উদ্দিন বাহাদুর শাহ এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। মসজিদটি নির্মাণ করতে প্রায় ৬০ বছর সময় লেগেছে। শুধু দেশ নয়, মসজিদটি দেখতে আসেন বিদেশী দর্শনার্থীরাও। শুক্রবার দিনে লোকজন বেশী আসেন মান্নত ও নামাজ আদায় করতে।

নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল বলেন, প্রাচীন এই মজজিদটি দেখ​_তে প্রতিদিন দর্শনার্থীরা আসেন দেশবিদেশ থেকে। ইতোমধ্যেই রেস্ট হাউজ ও পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। পর্যটন সম্ভবনার বিকাশ ঘটাতে আরো পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

সম্পাদক: এস এম আকাশ

অনুসরণ করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন

স্বত্ব © ২০২৩ কাজী মিডিয়া লিমিটেড

Designed and Developed by Nusratech Pte Ltd.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More