মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের অনেকের মধ্যে তেমন কোনো আগ্রহ ও উৎসাহ–উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে না। উল্টো প্রতিদ্বন্দ্বী দুই চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সম্প্রতি হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ, গুলি, মহাসড়ক অবরোধ, পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি এবং মামলার ঘটনায় এই নির্বাচন নিয়ে ভোটাররা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় রয়েছেন।
এ নির্বাচনে শিবালয় উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে তিনজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউর রহমান খান এবং জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুর রহিম খান এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ ছাড়া চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মোবারক হোসেনও (নির্দলীয়/স্বতন্ত্র) নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন।
দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় ব্যবসা–বাণিজ্য ও রাজনৈতিক আধিপত্য নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী রেজাউর রহমান খান এবং রহিম খানের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে তাঁদের মধ্যকার এই দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে যায়।
সম্প্রতি এ উপজেলায় কয়েকটি ঘটনা নিয়ে ভোটারদের মধ্যে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। ফলে প্রার্থীদের পাশাপাশি কর্মী–সমর্থকেরাও ভোট চাইতে গিয়ে তেমন সাড়া পাচ্ছেন না। গত বৃহস্পতিবার (১৫ মে) সরেজমিনে উপজেলার শিবালয়, বোয়ালী, টেপড়া, দশচিড়া, মহাদেবপুর এবং আরিচা ঘাটসংলগ্ন নেহালপুর এলাকায় অন্তত ২০ জন ভোটারের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের উদ্বেগের কথা জানা গেছে।
গত শুক্রবার (১০ মে) বিকেলে উপজেলার আরিচা ঘাটের অদূরে ডাক্তারখানা এলাকায় পোস্টার লাগানোকে কেন্দ্র করে রেজাউর রহমান খান ও রহিম খানের কর্মীদের মধ্যে মারধরের ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে রেজাউর রহমানের ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক ফাহিম খান পিস্তল দিয়ে ফাঁকা গুলি ছোড়েন। এর প্রতিবাদে রহিমের কর্মী ও সমর্থকেরা ঘটনাস্থলের পাশে ঢাকা–আরিচা মহাসড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন। পরে স্থানীয় মানিকগঞ্জ–১ আসনের সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন মাহমুদ (জাহিদ) এবং পুলিশ সুপার মোহাম্মদ গোলাম আজাদ খান ঘটনাস্থলে যান। পরে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসে আড়াই ঘণ্টা পর মহাসড়ক থেকে বিক্ষোভকারীরা চলে যান। এ ঘটনায় ওই দিন দিবাগত রাতে দুইপক্ষই থানায় মামলা করেছেন।
এ ব্যাপারে ফাহিম খান বলেছিলেন, রহিম খানের কর্মীরা তাঁর ওপর হামলা করায় আত্মরক্ষায় তিনি নিজের বৈধ পিস্তল দিয়ে এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করেন। এর আগে গত ৭ এপ্রিল রহিমের অনুসারী উপজেলার আরুয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) তিন সদস্যকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। রেজাউরের ভাতিজা ইউপি চেয়ারম্যান মোনায়েম মোস্তাকিন (অনিক) ও তাঁর লোকজনের বিরুদ্ধে এই মারধরের অভিযোগ করা হয়। অবশ্য ইউপি চেয়ারম্যান দাবি করেন, এ হামলার সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
গত ২৭ এপ্রিল রাতে নির্বাচনী প্রচারণা শেষে ফেরার পথে রহিম খানের বহনকারী গাড়িকে লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। এ ঘটনায় থানায় রহিম খান অভিযোগ করে বলেন, উপজেলার বিরিরাস্তি এলাকায় তাঁর গাড়িতে ককটেল নিক্ষেপ ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করা হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রেজাউরের ছেলে ফাহিম খানসহ তাঁর কর্মীরা এই হামলা করেন। গত ৩০ এপ্রিল এ ঘটনার প্রতিবাদে এবং জড়িতদের শাস্তির দাবিতে উপজেলার টেপড়া এলাকায় পাল্টাপাল্টি মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।
এসব ঘটনায় নির্বাচনী মাঠের পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এতে ভোটকেন্দ্রে যেতে ভোটার মধ্যে উৎকণ্ঠার পাশাপাশি একধরণের অনীহা তৈরি হচ্ছে বলে সাধারণ ভোটার ও তৃণমূলের নেতা–কর্মীরা মনে করছে।
বুধবার (১৫ মে) দুপুরে উপজেলার বড় বোয়ালী গ্রামের মোক্তার শেখ (৭০) একটি চায়ের দোকানে চা পান করছিলেন। এ সময় এবারের নির্বাচনী আমেজ নিয়ে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আগে নির্বাচনে আমোদ–ফূর্তি আছিল। মানুষ গলায়–গলায় ধরে ভোট দিয়্যা আইছে। আগে দলাদলি থাকতো না। যে যেই পার্টির (দলের) হইতো, হে ও (প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা) ক্যাম্বাস করতো, কোনো সমস্যা অইতো না। কিন্তু এহন এইহানে যে পরিবেশ, হেই রহম থাকলে ম্যালা (অনেক) মানুষ ভোট দিবার যাইবো না। পরিবেশ সুষ্ঠু থাকলে ভোট দিবার যামু।’
আরিচার অদূরে ডাক্তারখানা এলাকায় নরসুন্দরের কাজ করেন শিবালয় গ্রামের তান শীল (৭৬)। তিনি বলেন, ‘দুই প্রার্থীর কেউ কারো চেয়ে কম না। নাড়াই–ঝগড়া না অইলেই ভালো। ভালো পরিবেশ থাকলে ভোট দিবার যামু।’
শিবালয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ১ নাম্বার ওয়ার্ডের সদস্য রফিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমান যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে ভোটারদের মধ্যে একধরণের আতঙ্ক কাজ করছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশের আশ্বাস না দেওয়া হয়, তাহলে ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি কম হতে পারে।
ভোটার উপস্থিতি নিয়ে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী রহিম খান নিজেই সন্দিহান। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ছাড়া অন্য কারো কাছে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র থাকার কথা নয়। কিন্তু তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ছেলের কাছে কিভাবে থাকে, প্রশাসন তা দেখে না! বর্তমানে যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে ভোটার উপস্থিতি কমবে, বাড়বে না।’
শিবালয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুর রউফ সরকার বলেন, তফসিল ঘোষণার পর থেকে নয়, ভোটগ্রহণের সাতদিন আগে ও সাতদিন পরে বৈধ অস্ত্র বহন ও প্রদর্শন করা যাবে না। দুইপক্ষের মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, মামলায় অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
প্রতিদ্বন্দ্বী চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী রেজাউর রহমান খান বলেন, ‘শান্ত এ উপজেলা তাঁরাই (রহিম খান) অশান্ত করে তুলছেন। আমাদের কর্মী–সমর্থকদের মারধর, হুমকিধামকি দেওয়া হচ্ছে। আমরা সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোটের পক্ষে।’
ভোটারদের আশ্বস্ত জানিয়ে শিবালয় উপজেলা নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত (মোবাইল টিম) থাকবে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী পর্যাপ্তসংখ্যক সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন।
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দ্বিতীয় ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জেলায় শিবালয়, ঘিওর ও দৌলতপুর–এ তিনটি উপজেলায় আগামী ২১ মে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গত ২১ এপ্রিল প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল। মনোনয়নপত্র যাচাই–বাছাই হয় ২৩ এপ্রিল এবং প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল ৩০ এপ্রিল।
চন্দন/ আল / দীপ্ত সংবাদ