ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত মন্তব্যের কারণে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যাচার ও শপথ লঙ্ঘনের’ অভিযোগ তুলেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। এর সূত্র ধরে এরই মধ্যে বঙ্গভবন থেকে তাঁর বিদায়ের দাবিতে বিক্ষোভ করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি, তাতে রাষ্ট্রপতিকে সরানোর সুযোগ আছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
রাষ্ট্রপতিকে সরানো কি সম্ভব?
সংবিধান ও আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় সংসদ রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করতে পারলেও সংসদ না থাকায় এখন সে সুযোগও নেই। পদ ছাড়লে তাকে পদত্যাগপত্র দিতে হবে স্পিকারের কাছে। যেহেতু স্পিকার পদত্যাগ করেছেন এবং ডেপুটি স্পিকার কারাগারে আছেন, তাই সেই সুযোগও এখন তার নেই।
তারা বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর সংবিধানের বিষয়টি এখন গৌণ হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ (বিশেষ পরিস্থিতির নীতি)। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ কিংবা নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিই কাজ করবে বলে মনে করেন তারা।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সংবিধান বিশ্লেষক ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সংবিধান অনুযায়ী অনেক কিছুই হচ্ছে না। তাই রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ, অপসারণ কিংবা নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ সংবিধান মেনে হবে না। দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের দাবির মুখে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বেশ কয়েকজন বিচারক পদত্যাগ করেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান পদত্যাগ করেছেন। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে হাইকোর্টের ১২ জন বিচারককে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছে। এখন তারা যেটা সঠিক মনে করছে, সেই দাবি করছে এবং সেই দাবি মেনে নিয়ে অনেকেই পদত্যাগ করছেন। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট যে, ছাত্র–জনতা যদি জোরালো দাবি করে তাহলে অতীতের মতো পদধারীরা যেভাবে পদত্যাগ করেছেন, এখানেও সেভাবেই হবে। এখানে নতুনত্বের আর কী আছে?’
যদি পদত্যাগ করেন তাহলে রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগ করতে পারেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এতদিন যে কাজগুলো হয়েছে (বিভিন্ন পদধারীদের পদত্যাগ) সেগুলো কি কোনো সংবিধান মেনে হয়েছে? অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলে সংবিধানে কি কিছু আছে? কিন্তু হয়েছে তো। সংবিধান এখন গৌণ হয়ে গেছে। তাই সংবিধানের প্রশ্ন কেন তুলবেন? সংবিধান প্রযোজ্য হওয়ার কোনো সুযোগও এখন নেই।’
বর্তমান রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নিয়োগ কীভাবে হতে পারে এমন প্রশ্নে শাহদীন মালিক বলেন, ‘ছাত্র–জনতা যাকে যোগ্য মনে করবে তিনিই রাষ্ট্রপতি হবেন।’
সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদ বলছে, আইন অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের দ্বারা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন। একই অনুচ্ছেদের বিভিন্ন উপ–অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা–অযোগ্যতার বিষয়ে বলা হয়েছে। সংবিধানের ৫০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন এবং এই পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। তবে শর্ত হিসেবে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির পদের মেয়াদ শেষ হওয়া সত্ত্বেও তার উত্তরাধিকারী–কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি তার পদে বহাল থাকবেন। আর পদত্যাগের বিষয়ে ৫০ অনুচ্ছেদের (৩) উপ–অনুচ্ছেদ বলছে, রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করতে চাইলে স্পিকারের উদ্দেশে স্বাক্ষরযুক্ত পত্র দিয়ে তিনি পদত্যাগ করতে পারবেন।
রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যা ভাবছেরাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যা ভাবছে
জটিল পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি নিয়োগে নজির হিসেবে ১৯৯০ সালে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পদত্যাগের পর তখনকার প্রধান বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দীন আহমদের দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়টি সামনে আনছেন আইনজীবীরা। তিন জোটের আন্দোলনের মুখে এরশাদ পদত্যাগে রাজি হওয়ার পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে তার কাছে পদত্যাগপত্র দেন এরশাদ। পরে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পান। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ওই বছরের ৬ আগস্ট সংবিধানের একাদশ সংশোধনী পাস হয়। তাতে প্রধান বিচারপতি থাকাবস্থায় বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগদান বৈধ ঘোষণা এবং তার প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যাওয়া বৈধতা পায়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখন না আছে সংসদ, না আছে স্পিকার। এই মুহূর্তে বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী পদত্যাগপত্র পাঠানোর মতো কোনো সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষ নেই। অর্থাৎ একধরনের সাংবিধানিক জটিলতা বা শূন্যতা আছে।’ তিনি বলেন, “আপাতদৃষ্টিতে ধরে নিলাম সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে হলেও প্রধান উপদেষ্টা তার পদত্যাগপত্রটি গ্রহণ করলেন এবং পরবর্তী সময়ে আইন অনুযায়ী এটাকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। সংবিধানে বিধান না থাকলেও ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ অনুযায়ী প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতে পারেন।’
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘এখন নিয়োগটা কীভাবে হবে, সে প্রশ্ন সামনে চলে আসে। যদি সাংবিধানিকভাবে নিয়োগের চিন্তা করা হয়, তাহলে সেটার কোনো সুযোগ এই মুহূর্তে নেই। তাই বলে কি রাষ্ট্রপতি নিয়োগ হবে না? এ ক্ষেত্রে আবারও সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। আর এর সমাধান হতে পারে রাজনীতির মধ্যে। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি একটা ঐকমত্য হয়, তাহলে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে এবং আপাতত এর বাইরে কোনো সমাধান আসলে নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের নিয়োগের পর বৈধতার প্রশ্ন আসবে। যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে নিয়োগটা হচ্ছে, তাহলে পরবর্তীকালে নির্বাচনের পর যে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসুক না কেন, এটাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না তাদের। এটাকে বৈধতা দেবে তারাই এবং এজন্য সংবিধান সংশোধন, সংযোজন–বিয়োজন যা করতে হয় তা–ই করবে।’
সূত্র: দেশ রূপান্তর
আল/ দীপ্ত সংবাদ