রাজধানীর ফুসফুসখ্যাত রমনা পার্কে আলোকচিত্রী ও শ্রমিক ও নারী আন্দোলনের সংগঠক তাসলিমা আখতারের তিন দিনব্যাপী ‘ভালোবাসি রমনা: প্রাণ ও প্রকৃতির গল্প‘ আলোকচিত্র প্রদর্শনী শুরু হয়েছে।
বুধবার (১০ ডসিম্বের) সকাল ৮টায় পার্কের শকুনতলা চত্বরে প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক তানজিম ওয়াহাব।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন– দৃক পিকচার লাইব্রেরির ব্যবস্থাপক ও কিউরেটর এএসএম রজোউর রহমান, আর্ন্তজাতিক দৌড়দিব রমনা পার্কের অন্যতম চেনা মুখ খবীর উদ্দিন খান, পার্কের মহিলাঙ্গনের অন্যতম সংগঠক ও শরীর চর্চা পরিচালক কোহিনুর হক ও পার্কের সঙ্গীরা।
শুরুতে ফুল দিয়ে তানজিম ওয়াহাব, তাসলিমা আখতারসহ সবাইকে বরণ করে নেয় শকুনতলা চত্বরের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। ১০ বছরের রমনা পার্কে পদচারণার গল্প নিয়ে তাসলিমা আখতারের তিন দিনব্যাপী এই প্রর্দশনী চলবে শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) পর্যন্ত।
জাতীয় জাদুঘররে মহাপরিচালক তানজমি ওয়াহাব বলেন, তাসলিমা আখতারকে একজন মানবাধিকর কর্মী, আলোকচিত্রী ও শিক্ষক। আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধু। আমরা একসঙ্গে পড়েছি। অনেক আগে থেকে তিনি ছবি তুলেন। তার একটি ছবি রানা প্লাজায় তোলা যেটা কেউ ভুলতে পারবে না (দ্যা ফাইনাল এমব্রেস)। সেই দৃশ্য আজও আমাদের শিউরে তোলে। আজকে নতুন কাজ দেখলাম। তার নানা কাজের মাঝেও কমিনিউনিটির মাঝে থেকে প্রাণ ও প্রকৃতি পরিবেশের গল্প।
তাসলিমা আখতার বলেন, ১০ বছর রমনা পার্কে ভোরে হাটার সময় নানা অভিজ্ঞতার ছবি আছে এই প্রদর্শনীতে। এই প্রদর্শনীতে মানুষ, গাছ, পালা, পাখি, ফুল, কাঠবিড়ালীর সঙ্গে কথা হবে, ছবির সঙ্গে সঙ্গে দর্শকের। ঢাকার নি:শ্বাস রমনার গল্পের মাঝে মাঝে নবীন ও প্রবীণ, আনাগোনার গল্প পাওয়া যাবে। দেখা যাবে নারীদের উপস্থিতি কীভাবে বেড়েছে। দেখা মিলবে প্রবীণ–নবীন কিভাবে প্রতিদিনের ব্যস্ততার মাঝে সুস্থতা ও স্বস্তির জন্য আসেন এখানে।
তিনি বলেন, গত ১০ বছরে ঢাকার বদলের সাথে সাথে পার্কের বদল ও স্মৃতির গল্প প্রদর্শনীটি। পার্কের সাথে কিভাবে প্রতিদিন শরীর চর্চা করা বা হাাঁটার পাশাপাশি সম্পর্ক তৈরি হয় মানুষের। একইসঙ্গে ইতিহাসের স্বাক্ষী হবে একেকটি ছবি। মোট ৫৫টি ছবি নিয়ে এই প্রদর্শনীটি চলছে। এই প্রদর্শনীটি কথা বলে রমনা পার্ক ও পার্কের মানুষ নিয়ে একই সাথে এই ঢাকা শহের আরো সবুজ ও প্রাণের আকাঙ্খা জানান দেয়।
আমন্ত্রিত অতিথিরা জানান, সাধারণত একজন আলোকচিত্র্রী ছবি তোলেন, মানুষের কাছে যান, পরিচয় জাননে এবং ক্যাপশন লিখেন। তাসলিমার ক্ষেত্রে কখোনই মনে হয়নি যে তার ছবির আলাদা ক্যাপশনের প্রয়োজন আছে। তার ছবিই কথা বলে ছবির মানুষগুলো তাসলিমার পরচিতি, ঘনিষ্ঠ অনেকের সঙ্গেই তিনি আন্দোলন করছেন। রমনায় তাসলিমা আখতারের কাজের মধ্যে দিয়ে নীরবে মানুষের সাথে প্রকৃতি সাথে তার সম্পর্ক দেখা যায়। যে কমিউনিটির মধ্যে তিনি ছবি তুলেছেন; সেই কমিউনিটির মাঝেই ফিরে গেছেন। এটাই তাসলিমার কাজের বৈশিষ্ট্য।
ভালোবাসি রমনা: প্রাণ ও প্রকৃতির গল্প
প্রতিদিনের হাঁসফাস, দম–বন্ধ একঘেয়ে নাগরিক জীবন পথ খোঁজে দম ফেলার। শহর জুড়ে উঁচু উঁচু চিকচিকে কাঁচের দালান অনেক অনেক এয়ারকন্ডিশন। বড় বিল্ডিংয়ে ঢাকার আকাশ, পূর্ণিমার চাঁদ। ব্যস্ত জীবন, ভীষণ একাকিত্ব। পথে পথে ধোঁয়া ধূলি। ধুসর সবুজ পাতা। ধুসর মেগা সিটি। এসবের মাঝে একচিলতে সবুজ, এক ফালি আকাশ, নি:শ্বাস নেবার একটু জায়গা পেলেই আঁচ করি কতটা কাঙ্গাল হতে পারে নগর জীবন। নগর জীবনে একটি পার্ক, সবুজের সংস্পর্শ, পার্কের মানুষ, তাঁদের একাকীত্ব–সম্পর্ক, নারীর উপস্থিতি এসবকেই জানা বোঝা আমার আগ্রহ। এসবই আমার ছবি গল্পের খুঁটিনাটি। গত ১০ বছরের পার্কে ভোরে হাঁটতে এসে পাওয়া নানা অভিজ্ঞতা। আজকরে রমনা পার্ক শুধু একটি সবুজ অঞ্চল নয়—এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও নাগরিক জীবনরে প্রতীক। রমনা বটমূল বাংলা নববর্ষের চর্চায় যেমন প্রাণ জোগায়, তেমনি পার্কের প্রতিটি পথ ও বৃক্ষ বহন করে বহু সময়ের স্মৃতি।
প্রতিদিন সূর্য ওঠার সাথে সাথে এই উদ্যানে গাছ–গাছালি, ফুল–পাতা যেন জেগে ওঠে মানুষের পায়ের আওয়াজের তালে তালে। স্বাস্থ্য সচেতনতায় কিংবা কেউবা রোগ বালাই থেকে মুক্ত হার ভাবনায় প্রতিদিন পাখির মতো ভিড় করে এ আঙ্গিনায়। জড়িয়ে পড়ে নানান সম্পর্কে। বছরের পর বছর পাশাপাশি হেটে চলা নাম না জানা অচেনা মানুষটি চেনা হয়ে উঠে, আপন হয়ে ওঠে একে অপরের। আপন হয়ে উঠে গাছ–ফুল–ফুলের গন্ধ, পাতা পড়া আর বাতাসে শব্দ, আঁকা বাকা পথ। ঋতু বদলায়, গাছ ফুল পাতার রং বয়স গন্ধ বদলায় যেমন বদলায় মানুষ। এভাবে প্রতিদিন ভোরে জমা হয় অনেক জীবনের গল্প সারাদিনের প্রাণের খোরাক। এভাবেই নাগরিক জীবনে প্রাণের সঙ্গী হয়ে উঠে একটি পার্ক। এমনই একটি পার্ক ঢাকা শহরের রমনা পার্ক। নারী পুরুষের কলরব হাঁটাহাটি, শরীর চর্চা, সময় কাঁটানো, একাকীত্বের মাঝে এভাবেই একটি পার্কের কাছে ঋণী হয়ে পড়ে নাগরিক জীবন। আকুতি বাড়ে আরো আরো সবুজের, আকুতি বাড়ে একাকীত্ব দূর করার, আকুতি বাড়ে ওই সাহসী নারী হবার। যে মধ্যবিত্ত নারী শত পুরুষের মাঝে জড়তা দূরে ঠেলে দৌড়ে সবুজের মধ্যে মিশে। যে নারী ইউরোপিয়ান নয় যে নারী এশিয়ার এ দেশের কাদামাটির।
ভালোবাসি রমনা সিরিজটি গত প্রায় ১০ বছর জুড়ে ঢাকার রমনা পার্কে আমার যাত্রার একটি চিত্র। পার্কে হাঁটা শুরু করার প্রায় ছয় মাস পর থেকে প্রথম ছবি তোলা শুরু। যখন থেকে পার্ক আর পার্কের মানুষের কিছুটা কাছাকাছি হতে পেরেছি বলে মনে হয়েছে তখন থেকেই কাজটি শুরু। এই কাজটি প্রথম পার্কের মাঝে প্রদশনী করার ইচ্ছা থেকে আজকের প্রদর্শনী। কারণ এই পাকের মাঝেই এই ছবিগুলোর প্রাণ। প্রদর্শনীটি আগামী ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত চলবে।