বিজ্ঞাপন
বুধবার, নভেম্বর ২০, ২০২৪
বুধবার, নভেম্বর ২০, ২০২৪

বিতর্কিত কর্মকর্তাদের শাস্তিমূলক বদলি কেন রংপুর বিভাগে?

Avatar photoদীপ্ত নিউজ ডেস্ক

মেহেদী সুমন

গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বারডেম হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে রাজধানীর শাহবাগ থানায় তিন নেতাকে বেধরক মারধরের ঘটনায় ডিএমপির সাবেক এডিসি হারুন অর রশিদকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত আলোচিত এডিসি সানজিদা আফরিনকে রংপুর পিটিসিতে বদলি করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার(২৪ অক্টোবর) পুলিশ মহাপরিদর্শক(আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ বদলি করা হয়।

বাংলা সিনেমায় বা টেলিভিশন বিজ্ঞাপন চিত্রে আমরা প্রায়ই দেখা যেত, প্রভাবশালীর ভূমিকায় থাকা ব্যক্তি কিংবা উর্ধতন কর্তৃপক্ষ সরকারি কর্মকর্তাকে বান্দরবানখাগড়াছড়িতে পাঠিয়ে দেবার হুশিয়ারি দিতেন।

যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চারিত্রিক স্খলন,সরকারি দায়িত্ব পালনে গাফিলতি,গুরুতর অসদাচরণ,দুর্নীতির অভিযোগ কিংবা কোন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছে তাদেরকে পার্বত্য এলাকায় বদলি করা হত।কারণ সেখানকার সুনশাননিস্তব্ধতা, দূর্গম অবস্থিতি,সন্তানের লেখাপড়ার জন্য মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং উন্নত চিকিৎসা সেবার অভাব রয়েছে।পার্বত্য অঞ্চলের দূর্বল অবকাঠামো,অনুন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা,যাতায়াতে ভোগান্তি এবং ঘুষ দুর্নীতির সুযোগ অনেক সীমিত হওয়ায় এ অঞ্চলে পদায়ন বা বদলি একটি দুঃস্বপ্ন হিসেবেই বিবেচিত হয়।

সরকারি কর্মকর্তা যারা পানিশমেন্ট পোস্টিং হিসেবে পাহাড়ি এলাকায় বদলির মুখে পড়েন,তাদের চাকরি জীবন এটি পদোন্নতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট নেতিবাচক প্রভাবে ফেলে।এ

কারণে সরকারি কর্মকর্তারা বান্দরবান,খাগড়াছড়ি, রাঙামাটির মতো জায়গায় সহজে বদলি হতে চান না।

বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে শাস্তিমূলক বদলির জায়গায় পার্বত্য অঞ্চলের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে দারিদ্র্য পীড়িত রংপুর বিভাগ।সীমাহীন উন্নয়ন বৈষম্য এবং নজিরবিহীন বঞ্চনায় জর্জরিত রংপুর বিভাগ কি কর্মস্থল হিসাবে দূর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের চেয়েও অধিকতর খারাপ প্রশাসনিক অঞ্চল?

দেশব্যাপী বিতর্কিত,সমালোচিত এবং ঘুষদুর্নীতি কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের পুনর্বাসনে শাস্তিমূলক বদলি হিসেবে রংপুরকে বেছে নেওয়া হচ্ছে।এতে প্রশাসনিক অঞ্চল হিসাবে রংপুর বিভাগে ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন এ অঞ্চলের সাধারণ জনগণ।

বঞ্চনার ধারাবাহিকতা কি কোন আমলেই শেষ হবে না?

রংপুরের জনগণ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের দায়িত্বে সরকারি সেবা গ্রহণে ইচ্ছুক নয়।

গত ৫ আগস্ট প্রবল গণবিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড.ইউনুসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়।বৈষম্য বিলোপের আকাঙ্খায় রংপুরের সন্তান আবু সাইদ প্রথম মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে এই গণবিক্ষোভের সূচনা করেছিলেন।কিন্তু রংপুরের প্রতি এমন ধারাবাহিক রাষ্ট্রীয় অবহেলা এবং বৈষম্যে বিলোপের কোন সুস্পষ্ট লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

গত ২৬ আগস্ট,২০২৪ তারিখে কুমিল্লার বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত ওসি ফিরোজ হোসেন এবং বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর,২০২৪) ডিএমপির আলোচিত এডিসি সানজিদা আফরিনকে রংপুর পিটিসিতে বদলি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশাসনও রংপুরের প্রতি বিগত সরকারের সেই একই নীতি জিইয়ে রেখেছে।রংপুরের প্রতি এমন সরকারি হীনমন্যতা এ অঞ্চলের অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।যা অত্যন্ত হতাশাজনক।

বিতর্কিত সরকারি কর্মকর্তাদের শাস্তিমূলক বদলির জায়গা হিসাবে রংপুরকে কেন বেছে নেওয়া হয়েছে তা পুরোপুরি অজানা নয়।বিগত সরকারের সময়ে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার বাজেট বৈষম্যের কারণে উত্তরাঞ্চলে দৃশ্যমান কোন উন্নয়ন,শিল্পায়ন,আলাদা শিল্পনীতি,পুঞ্জীভূত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের হাব,কর্মসংস্থান সৃষ্টি কিংবা দারিদ্র্য বিমোচক কোন মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়নি।

দেশের ১০ টি দরিদ্রতম জেলার ৫ টি রংপুর বিভাগে অবস্থিত।সরকারের অবহেলা এবং বিমাতাসুলভ আচরণের

কারনে পার্বত্য অঞ্চলের পরিবর্তে রংপুর বিভাগ আলোচিত ও বিতর্কিত কর্মকর্তাদের পানিশমেন্ট পোস্টিংয়ের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।

রংপুরের অবস্থা কতটা শোচনীয় তা পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার বেগম নুরজান্নাত রুমি কে রংপুর বদলি করার ঘটনায় সহজে অনুমেয়।২০২০ সালের জুলাই মাসে তুমুল পারিবারিক বিতর্ক ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের কারণে আলোচিত এই কর্মকর্তাকে রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে বদলি করা হয়।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নারী কেলেঙ্কারি,অনিয়ম,দুর্নীতি এবং সরকারি টাকা আত্মসাতের কারণে নড়াইলের বিতর্কিত ডা. শশাঙ্ক চন্দ্র ঘোষকে রংপুরে বদলি করা হয়।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে নারী সহকর্মীকে ঘিরে সৃষ্ট উত্তেজনায় শাহবাগ থানায় নিয়ে ছাত্রলীগের তিন নেতাকে মারধরের ঘটনায় ডিএমপির(এডিসি) হারুন অর রশীদকে রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়।তার সহকর্মী সেই পুলিশ কর্মকর্তা সানজিদাকে গতকাল ২৪ অক্টোবর রংপুর পিটিসিতে বদলি করা হয়েছে।

২০২২ সালে কপালে টিপ পরায় এক নারী শিক্ষককে হেনস্থার প্রতিবাদকারীদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় সিলেট জেলা পুলিশের আদালত পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে প্রত্যাহার করে রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়।

২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতে ইসলামের ব্যাপক বিক্ষোভের ঘটনায় ওসি আবদুর রহিমকে প্রত্যাহার করে রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়।

বহুল আলোচিত সোনাগাজীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় বিতর্কিত ওসি মোয়াজ্জেমকে ২০১৯ সালের মে মাসে রংপুরে বদলি করা হলে সেখানাকর জনগণ এর বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করে।

একই বছর টঙ্গী পূর্ব থানার বিতর্কিত এসআই মাদক মাসোহারার জনক শাহীন মোল্লা এবং সিলেটের ওসমানিনগর থানার ওসি আল মামুনকে যোগদানের বর্ষপূর্তিতে লাখ লাখ টাকায় জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করার শাস্তি স্বরূপ রংপুরে বদলি করা হয়।

২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে ফেসবুকে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করায় ৩০তম বিসিএসে প্রথম স্থান অধিকারী কাস্টমস কর্মকর্তা সুশান্ত পালকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে রংপুরে পাঠানো হয়।

২০১৫ সালে সিলেটে বাবার সাথে অসাধাচরণ, মামলা নিতে গড়িমসি ও দায়িত্ব পালনে গাফিলতির অভিযোগে থানা থেকে প্রত্যাহারের পর জালালাবাদ থানার ওসি (তদন্ত)কে রংপুর রেঞ্জে বদলি করা হয়।

বিতর্কিত,অসৎ এবং অনিয়মদুর্নীতির অভিযোগে কারনে রংপরের বদলির এমন আরো অগণিত উদাহরণ রয়েছে। শাস্তিমূলক বদলির কর্মস্থল হিসেবে রংপুর দূর্গমনির্জন অঞ্চল বা দ্বীপ নয়।তবে রংপুরে সরকারি সুযোগসুবিধার অভাব,অনুন্নত অবকাঠামো, শিক্ষাচিকিৎসা,শিল্পায়ন এবং ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মচঞ্চলতার অভাব রয়েছে।এমন বাস্তবতা যে রাষ্ট্রস্বীকৃত তা পানিশমেন্ট পোস্টিংয়ের চলমান পরিস্থিতির মাধ্যমে খুব সহজে অনুধাবন করা যায়।এতে প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে রংপুরের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে।এ বিভাগের মানুষ অত্যান্ত সহজ সরল প্রকৃতির হওয়ায় এসব বির্তকিত কর্মকর্তারা আরো আশকারা পেয়ে জনস্বার্থ বিরোধী কাজ করতে পারে।শাস্তির মুখোমুখি এসব কর্মকর্তাকে রংপুরে বদলির বিষয়টি জনগণ বৈষম্য এবং নিপীড়নমূলক নীতি হিসেবে দেখছে।সেখানকার মানুষ এসব বিষয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদও করেছে।

রংপুরের প্রতি এমন রাষ্ট্রীয় অবহেলা এবং বঞ্চনার অবসানে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।রংপুর স্বাধীনসার্বভৌম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ।কাজেই এ বিভাগের প্রতি যেকোন ধরনের নেতিবাচক এবং বৈষম্যমূলক নীতির অবসানে রাষ্ট্রকেই অগ্রবর্তী ভূমিকায় এগিয়ে আসতে হবে।রংপুর বিভাগকে পানিশমেন্ট নয় বরং জনস্বার্থের ক্রিম পোস্টিংয়ের কর্মস্থল হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারকে সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

বিভাগটির আট জেলার পৌনে দুই কোটি জনগণের সার্বিক জীবনমান উন্নয়নে আলাদা শিল্পনীতি,বিশেষ ঋণনীতি ও বাজেট বরাদ্দ,বিদেশে কর্মী প্রেরণে প্রণোদনা,এসএমই শিল্পের বিকাশে সহজ শর্তে ঋণ,দারিদ্র্য নিরসনে বিভিন্ন মেয়াদী প্রকল্প, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকারকে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আল/ দীপ্ত সংবাদ

আরও পড়ুন

সম্পাদক: এস এম আকাশ

অনুসরণ করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন

স্বত্ব © ২০২৩ কাজী মিডিয়া লিমিটেড

Designed and Developed by Nusratech Pte Ltd.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More