তামাকের ক্ষতি হ্রাসে বাস্তবসম্মত নীতি গ্রহণ করে সফলতা পেয়েছে নিউজিল্যান্ডসহ অনেক দেশ। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো এ ধরনের কোনো নীতি বা কৌশল নেই। ফলে কঠোর বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও যথাযথ বাস্তবায়ন ও অনুমোদনের অভাবে তামাক এখনো বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য একটি কার্যকর ও বাস্তবসম্মত তামাক ক্ষতি হ্রাস নীতি প্রণয়ন করা অপরিহার্য। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে বর্তমানে আইন থাকলেও সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন হয় না, সেখানে এই ধরনের নীতি খুবই প্রয়োজন।
সোমবার (১৩ অক্টোবর) ঢাকায় অবস্থিত হোটেল রেনেসাঁয় “পলিসি ফর প্রগ্রেস: টুয়ার্ডস হার্ম রিডাকশন ২.০” শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এই মন্তব্যগুলি করেন। হোটেল রেনেসাঁয় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ হার্ম রিডাকশন ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ সেমিনারের আয়োজন করে।
আলোচনায় ওয়ার্ল্ড মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল ডা. ডেলন হিউম্যান বলেন, নিউজিল্যান্ড বাস্তবভিত্তিক ও বৈজ্ঞানিক কৌশল গ্রহণ করে সফলভাবে ধূমপান কমিয়ে আনতে পেরেছে। সেখানে ভেপিংয়ের মতো বিকল্পকে স্বীকৃতি দিয়ে মানুষকে ধূমপান ছাড়ার বাস্তব পথ দেখানো হয়েছে। এর ফলে মাত্র কয়েক বছরে দেশটিতে ধূমপানের হার প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত ‘টেল অব টু নেশনস: বাংলাদেশ ভার্সেস নিউজিল্যান্ড’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০১৫ সালে দেশটিতে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ধূমপায়ীর হার ছিল ১৩.৩ শতাংশ, যা বর্তমানে কমে হয়েছে ৬.৯ শতাংশ। অন্যদিকে, বাংলাদেশে এই হার ২৩ শতাংশ থেকে কমে ১৭ শতাংশ হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে এ পার্থক্যের বড় কারণ হলো— নিউজিল্যান্ডে ক্ষতি হ্রাস নীতিমালা কৌশলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে তা করা হয়নি।
বাংলাদেশ হার্ম রিডাকশন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ও চেয়ারম্যান এবং ‘টেল অফ টু নেশনস’–এর আরেক লেখক ড. মো. শরিফুল ইসলাম দুলু বলেন, ধূমপায়ীর হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে নিউজিল্যান্ডের এই সাফল্যের মূল কারণ হলো তাদের বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও তামাক নিয়ন্ত্রণে ক্ষতি হ্রাস কৌশলের অন্তর্ভুক্তি। দেশটি ভেপিংয়ের মতো বিকল্পকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দিয়ে ধূমপায়ীদের ধূমপান ছাড়ার জন্য কার্যকর নীতি প্রণয়ন করেছে।
অন্যদিকে, বৈজ্ঞানিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ক্ষতি হ্রাস কৌশলগুলো অনুশীলন করে না। এর পরিবর্তে, ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম বা ই–সিগারেট আমদানিতে সম্প্রতি যে নিষেধাজ্ঞার মতো অবাস্তব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। এর ফলে অবৈধ বা চোরাচালানের পথ প্রশস্ত হচ্ছে, যার ফলস্বরূপ সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে এবং ভোক্তারা একটি বিকল্প পছন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে ধূমপায়ীর হার ৩৪.১ শতাংশ, যা নিউজিল্যান্ডের তুলনায় চার গুণ বেশি। প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে বাংলাদেশে মৃত্যু হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার জনের। দেশের মোট মৃত্যুর ২১.৯ শতাংশই এই কারণে ঘটে।
অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হয়ে থোলোস ফাউন্ডেশনের কনজিউমার ইস্যুজের ডিরেক্টর টিমোথি অ্যান্ড্রুস বিকল্প তামাকজাত পণ্যগুলোর সঠিক নিয়ন্ত্রণ ও এ সংক্রান্ত নীতিমালা গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞা ও কঠোরতা আরোপ তামাক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর সমাধান নয়। ব্রাজিল সহ অনেক দেশে এটি বারবার প্রমাণিত হয়েছে। তাদের সর্বশেষ গবেষণা ‘প্রোহিবিশন ডাজ নট ওয়ার্ক’–এ এই বিষয়টি বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
সুইডেনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, গত তিন দশকে দেশটির বহু মানুষ ধূমপান ছেড়ে স্নাস নামক ধোঁয়াবিহীন ওরাল তামাকজাত পণ্য ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়েছেন। সিগারেটের তুলনায় এটি কম ক্ষতিকর এবং তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী হওয়ায় দেশটি এই ধরনের পণ্যের ওপর করের হারও কমিয়েছে। ফলে সুইডেন ধূমপানজনিত মৃত্যু ও রোগে আক্রান্ত মানুষের হার এখন অনেক কমে এসেছে।
বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন জামান বলেন, ধূমপানের ক্ষতি হ্রাসে কার্যকর বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন দেশে ভেপ সমাদৃত হলেও বাংলাদেশে এর আমদানি নিষিদ্ধ। তবে এই সত্ত্বেও চোরাকারবারীরা অবৈধ পথে ভেপ ঠিকই আনছে। ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্রি হচ্ছে অবৈধভাবে আমদানিকৃত ভেপ পণ্য। এতে বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। নীতিমালা না থাকায় ভেপ পণ্যগুলোর মানও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তাই এভাবে অবৈধ বাজার বাড়ার সুযোগ না দিয়ে বৈধভাবে ভেপ আমদানি ও বিক্রির সুযোগ দিয়ে এ বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। এটি বাংলাদেশেও ধূমপানের হার কমাতে এবং বিকল্প তামাকজাত পণ্য বা বৈধ ব্যবসায় জড়িত অনেকের জীবিকা সুরক্ষায় সহায়ক হবে।
সেমিনারের সমাপনী মন্তব্যে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের সিনিয়র ম্যানেজার হাসনাত আলম মূল সুপারিশগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তামাকজনিত ক্ষতি হ্রাস কৌশল গ্রহণ করা এবং এই বিষয়ে একটি আলাদা, বিস্তৃত নীতি প্রণয়ন করা অপরিহার্য। ক্ষতি হ্রাসকারী পণ্য নিষিদ্ধ করার পরিবর্তে এই নীতি গ্রহণ করা উচিত, কারণ নিষেধাজ্ঞা বাজার ও মান নিয়ন্ত্রণের ওপর বিপরীত প্রভাব ফেলে। তিনি আরও বলেন, এমন একটি নীতি কম ক্ষতিকর পণ্যগুলির দিকে ঝুঁকতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এবং ফলস্বরূপ, প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ীর সংখ্যা এবং এর সাথে জড়িত স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে পারে। তাঁর মতে, বাংলাদেশের উচিত হবে বাস্তবসম্মত ও দূরদর্শী নীতি গ্রহণ করা।