এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥
যাক পুরাতন স্মৃতি,যাক ভুলে–যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক॥
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা
রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক॥
হ্যাঁ, রাত পোহালেই পহেলা বৈশাখ! বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। বিভিন্ন উৎসবে, উপলক্ষ্যে, হাসি, কান্না, বেদনায়, জীবনের মিশ্র অনুভব–অনুভূতিতে বাঙালিকে বারবার ফিরে যেতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। ঠিক তেমনই আগামী রাঙা প্রভাতে বিশ্বকবি রচিত অমর এই গানটি ঠোঁটের কোণায় ধারণ করে মুঘল সম্রাট আকবরের হাত ধরে প্রচলিত নববর্ষ তথা নতুন বছর বরণের উৎসবে মেতে উঠবে সমগ্র বাঙালি জাতি। যদিও গত বছরের ন্যায় এ বছরও পহেলা বৈশাখ পবিত্র রমজান মাসে হওয়ায় সমগ্র আয়োজনে কিছুটা নিয়ন্ত্রণের ছাপ থাকবে। অন্যদিকে সঠিক ইতিহাস পর্যালোচনা না করেই নববর্ষ বরণের উৎসবকে হিন্দুয়ানি উৎসব বলে প্রপাগাণ্ডা ছড়াতে মত্ত একদল ধর্ম ব্যবসায়ী। কিন্তু উৎসব প্রিয় বাঙালি জাতিকে ধর্মের বেঁড়াজালে কে, কবে, কোথায় বেঁধে রাখতে পেরেছে?
গানটিতে প্রার্থনা করা হয়েছে, “মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা“। হ্যাঁ, আমাদের নাগরিক বা রাজধানীবাসীর জীবনে অগ্নি তথা আগুন খুব প্রিয় বন্ধু। কোনক্রমেই যেন আমাদের থেকে দূরে থাকতে চাই না। কখন, কোথায়, কিভাবে যে আগুন লাগে বুঝে ওঠা মুশকিল। তাই কবিগুরুর কথিত অগ্নিস্নানে ধরা তথা পৃথিবী কতটা শুচি বা পবিত্র হয় জানিনা, কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে খাঁক হয় অজস্র মানুষ, পরিবার আর স্বপ্ন। তাই আমাদের যাপিত জীবন থেকে গ্লানি কখনো মুছে যায় না, ঠিক যেমনটা ঘুচে যায় না জরাও। সাম্প্রতিককালে আগুন নিয়ে আমরা এতোটাই আতঙ্কিত যে, মনে হয় পুরো ঢাকা শহরটাই যেন একটা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি কিংবা মহাভারতের সেই লাক্ষা নির্মিত জতুগৃহ। যেকোন মুহূর্তে ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাতে ভস্মিভূত হয়ে যেতে পারে অসংখ্য প্রাণ ও পরিবার। তাই প্রতি বছর প্রথা মেনে এ শহরে কৃষ্ণচূড়ার ডালে আগুন লাগা ফাগুন আসে, কিন্তু নাগরিক জীবনে ফাগুন হাসে না!
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের অগ্নিকাণ্ড ও দুর্ঘটনা সংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারের অগ্নিকাণ্ডসহ তার পূর্ববর্তী দুই মাসে সারা দেশে ৯ দিনে ছোট–বড় মিলিয়ে চার হাজার ৩৪৭টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, মারা গিয়েছে ৪৭ জন। এরমধ্যে সর্বশেষ সাতদিনে মারা গিয়েছে ৩৫ জন; সিদ্দিকবাজার অগ্নিকাণ্ডে মৃতের সংখ্যা কম–বেশি ২৩ জন। গত দুই বছরে প্রতিদিন গড়ে ৬৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। গত ১৪ মাস ১০ দিনে সারা দেশে মারা গিয়েছে ১৪৫ জন। অগ্নিকাণ্ডে এক বছরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩৪২ কোটি ৫৮ লাখ ৫১ হাজার ৩৮৯ টাকা। ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২২ সালে সারা দেশে ২৪,১০২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৩৪২ কোটি টাকার বেশি সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০২১ সালে ২১,৬০১টি অগ্নিকাণ্ডে ২১৮ কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তথ্যানুসারে, সাম্প্রতিককালে বঙ্গবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৩৮৪৫টি দোকান পুড়ে ছাই হয়েছে যেখানে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে ৩০৩ কোটি টাকা।
এ তো গেলো পরিসংখ্যানের নির্দয় চিত্র। কিন্তু এসব অগ্নকাণ্ডের ঘটনায় কতশত মানুষের জীবন, শরীরের পাশাপাশি স্বপ্নও যে পুড়ে খাঁক হয়ে যায়, পরিসংখ্যানের খেরোখাতার সাধ্য কি তার হিসাব রাখে! অগ্নিকাণ্ডে পঙ্গুত্ব বরণ করে হাজারো মানুষ বোঝা হয়ে দাঁড়ায় পরিবার ও সমাজের। জীবন্মৃত এসব মানুষের চোখের পানি কখনো শেল হয়ে বিঁধে কী পেছনের কুশীলবদের? অগ্নিকাণ্ডের পর নিয়ম করে প্রতিবার তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু তদন্তের ফলাফল দিবালোকে আসা বোধ হয় পাপ! নয়তো নিমতলী, তাজরীন ফ্যাশনস, এফ আর টাওয়ার, চুড়িহাট্টাসহ অসংখ্য অগ্নিকাণ্ডের তদন্তের ফলাফল আজো আলোর মুখ দেখলো না কেন? ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ–পরোক্ষভাবে জড়িত কয়জনকেই বা বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো গিয়েছে? নাকি ফায়ার সার্ভিসের পানির নিচে আগুন যেমন চাপা পড়ে তেমনই প্রভাবশালীদের দোর্দণ্ড প্রতাপে ফাইলের স্তূপে চাপা পড়ে আগুন সন্ত্রাসীদের বিভৎস ইতিহাস।
কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। ছাইচাপা আগুন থেকেও কখনো কখনো রচিত হয় প্রবল অগ্নিকাণ্ড। যে আগুনে কোন একদিন পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাবে ঘটনার পেছনের কারিগররা, রচিত হবে নতুন ইতিহাস। মহাকাল সাক্ষী, বিশাল ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো ঘুরে দাঁড়াতে বাঙালির জুড়ি নেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে যা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে বর্বর পাকিস্তানিরা। বিশ্বব্যাংকের প্রবল চোখ রাঙানি অগ্রাহ্য করে মাননীয় প্রধামন্ত্রীর নেতৃত্বে নির্মিত হয়েছে স্বপের পদ্মা সেতু। বাস্তবতার ছোঁয়ায় রাজধানীবাসীর জীবন রঙিন হয়ে উঠেছে মেট্রো রেল–এর মতো সুবিশাল প্রকল্পে। অচিরেই উন্মোচনের অপেক্ষায় কর্ণফুলী টানেল। করোনাকালীন মহামারীতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও জিডিপি এবং উন্নয়ন সূচকে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে সগৌরবে মাথা উঁচু করে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে এগিয়ে চলেছে স্বদেশ। ঠিক তেমনই একদিন অগ্নিকাণ্ডের কুশীলবরা বিচারের মুখোমুখি হবে, নিশ্চিত হবে শাস্তি, শান্তি পাবে হাজারো অতৃপ্ত আত্মা।
নতুন বছরের ঊষালগ্নে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো আমাদেরও প্রার্থনা ‘যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে–যাওয়া গীতি, অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক, বৎসরের আবর্জনা দূরে যাক‘। আর প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী নচিকেতার মতো প্রত্যাশা ‘একদিন ঝড় থেমে যাবে, জীর্ণ মতবাদ সব ইতিহাস হবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে‘। আর সেই শান্ত পৃথিবীতে অগ্নিকাণ্ডের অভিশাপমুক্ত হয়ে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে আমরা সকলেই মনুষ্যত্বের অধিকারী মানুষ হয়ে মিলেমিশে থাকবো। জয় হোক মাটি ও মানুষের। শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪৩০।
জয়ন্ত কুমার সরকার
কলাম লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী