বাংলাদেশের রাজনীতির এক দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো। চিরবিদায় নিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। যিনি কেবল একজন রাজনীতিবিদই ছিলেন না, বরং প্রতিকূল সময়ে একটি বিধ্বস্ত দলকে কক্ষপথে ফিরিয়ে এনেছিলেন নিজের দৃঢ়তায়। সাধারণ এক গৃহবধূ থেকে হয়ে উঠেছিলেন এ দেশের রাজনীতির অন্যতম প্রধান চরিত্র।
খালেদা জিয়ার জীবন ছিল আটপৌরে। ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে জন্ম নেয়া এই মানুষটি শৈশব কাটিয়েছেন দিনাজপুরে। পরিবারের কাছে তিনি ছিলেন আদরের ‘পুতুল‘। ১৯৬০ সালে তৎকালীন ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর তার জীবন ছিল শুধুই স্বামী আর দুই সন্তান—তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে ঘিরে। এমনকি জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালেও খালেদা জিয়াকে রাজনীতির আঙিনায় দেখা যায়নি।
কিন্তু ১৯৮১ সালের মে মাসে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে এক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর সবকিছু বদলে যায়। ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে বিএনপি, তৈরি হয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল। সেই চরম বিপর্যয়ের মুখে ১৯৮৩ সালে দলের হাল ধরেন এই সাধারণ গৃহবধূ। ১৯৮৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন বিএনপি চেয়ারপারসন।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময় ছিল এরশাদ বিরোধী আন্দোলন। সেই সময় সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তার অনড় অবস্থান তাকে সাধারণ মানুষের কাছে ‘আপোষহীন নেত্রী‘র পরিচয় এনে দেয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পাঁচটি আসন থেকে লড়াই করে সবকটিতেই জয়লাভ করেন তিনি। সেই নির্বাচনের মাধ্যমেই তিনি গড়েন ইতিহাস—বাংলাদেশের প্রথম এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন তিনি।
তার প্রথম মেয়াদের অন্যতম বড় কৃতিত্ব ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন। তার হাত ধরেই দেশ পুনরায় গণতান্ত্রিক কাঠামোর সুফল পেতে শুরু করে।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো (তিন দফায়) প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। তবে তার রাজনৈতিক পথচলা সব সময় মসৃণ ছিল না। ২০০৭ সালের ওয়ান–ইলেভেন পরবর্তী পরিস্থিতি এবং ২০১৮ সালে দুর্নীতির মামলায় কারাবাস—তাকে বারবার কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলেছে। দীর্ঘ সময় কারান্তরীণ থাকা এবং পরবর্তীতে গুলশানের বাসভবনে কার্যত নিভৃতবাসে থাকার সময়গুলোতেও তিনি ছিলেন নিজ দলের নেতাকর্মীদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস।
বিগত কয়েক বছর ধরে লিভার সিরোসিস, কিডনি ও হৃদরোগসহ নানাবিধ জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। ২০২৪ সালের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর কারামুক্ত হয়ে তিনি কিছুটা রাজনৈতিক স্বস্তি পেলেও শারীরিক অসুস্থতা তাকে আর ফিরে আসার সুযোগ দেয়নি। লন্ডনে উন্নত চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার পর আবারও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাকে।
বিশ্লেষকদের মতে, খালেদা জিয়া শুধু একজন প্রধানমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন এমন এক নেত্রী যিনি ক্ষমতার বলয়ের বাইরে থেকেও একটি দলকে শক্তিশালী অবস্থানে টিকিয়ে রাখতে জানতেন। তার প্রয়াণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি সুদীর্ঘ ও প্রভাবশালী যুগের অবসান ঘটল। ‘পুতুল‘ থেকে ‘দেশনেত্রী‘ হয়ে ওঠার এই সফরটি বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।