বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ। সেখানকার একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম উলানিয়া। শ্যামল সুনিবিড় এ গ্রামের জমিদারবাড়ি বিশেষ হয়ে উঠেছিল আনুমানিক ১৭০০ শতাব্দিতে– সুবেদার হানিফের সময়।
মেহেন্দিগঞ্জে তখন ওলন্দাজ দস্যুদের দাপট। ছিল মগ আর ফিরিঙ্গিদের অত্যাচার। নির্যাতনে জর্জরিত সাধারণের রক্ষায় লাঠি ধরেন সুবেদার হানিফ। ঐক্যবদ্ধ শক্তি ফিরিয়ে দেয় ওলন্দাজ–মগ–ফিরিঙ্গিদের। দস্যুদাপট প্রতিহত হয়। নয়া বসতি স্থাপন করে পার্শ্ববর্তীরা।
পুরানো সে জমিদারবাড়ি আবারও গল্পের আধার হলো– ‘মেঘনা কন্যা’ সিনেমার মধ্য দিয়ে। যার পরিচালক ও কাহিনীকার ফুয়াদ আহমেদ চৌধুরী।
পেশায় সাংবাদিক মিস্টার চৌধুরী ডকুমেন্টারি তৈরি করতে গিয়ে এমন একটি কাহিনীর সন্ধান পান ২০০৩ সালে গাজীপুরে। আর সে ঘটনাই সিনেমার মধ্য দিয়ে এবার বাস্তব মানুষের সমান্তরাল চোখে ধরা দিয়েছে।
উদ্দেশ্য–বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে সচেতন করা। বিশেষ করে সরল গ্রামের সহজ মানুষ যারা না বুঝে তাদের মেয়েদের বিদেশ পাঠাতে তুলে দেন দালালের হাতে। পরবর্তী ঘটনা আর নেপথ্যের গল্প অজানাই থেকে যায় বহুজনে। গ্রাম আর শহুরে নারীর শেকল ভাঙার যুথবদ্ধ গল্প মেঘনাকন্যা।
সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর গ্রামে বেড়াতে যাওয়া হালফিল মেয়ে প্রজ্ঞা ফিরতে চায় শহরে। চলতি পথে চোখে ধরে পুরনো এক ভবন। কয়েক’শ বছর আগে ঠগি মগরা যখন আক্রমণ চালাতো উলানিয়ায় তখন আস্ফালন থেকে বাঁচতে এ ভবন থেকে ছোঁড়া হতো কামানের গোলা। এত পুরানো বাড়ি অথচ এখনও নির্জলা নান্দনিক। দেয়ালের খাঁজ আর ভেতরের টেরাকোটার ভাঁজে তরুণী প্রজ্ঞা খুঁজে পেলো অশীতিপর নস্টালজিয়া। উত্তরপুরুষের নিউরণ কোষ সবুজপাতাদের মতো নেচে–গেয়ে উঠলো।
পূর্বপুরুষের ভিটেয় তার বাবা যেমন থিতু হতে চেয়েছেন–তেমনি। টেরাকোটায় অনিন্দ্য নাচের ফর্ম খুঁজে পায় মেয়েটি। সেই গ্রামে এমন মুদ্রায় নাচতে পারেন আরেকজন। তিনি বাউলকন্যা। নাম যার হাসি। অথচ হাসি তখন দূর অজানায়। ভারতের পতিতাপল্লীতে আটকে আছে সর্দারনীর ডেরায়। সবাই জানে বিদেশ গেছে চাকরি করতে। প্রজ্ঞার অনুসন্ধানে ক্রমশ মেয়ে পাচারকারীর সন্ধান পেতে থাকে হাসির পরিবার। সহযোগী হিসেবে কাজ করে প্রজ্ঞার বাবা–মা আর গ্রামে গিয়ে হঠাৎ পাওয়া ভালোবাসার আরেক মানুষ।
ভগ্নপ্রায় এক সংসারের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাকে উপস্থাপন করা হয়েছে ‘মেঘনা কন্যা’তে। যেখানে উঠে এসেছে পাশের দেশ ভারতের পতিতালয়ে বাংলাদেশের মেয়ে পাচারের খণ্ডিত কাহিনী। একটি পরিবার কিভাবে ধ্বংস হতে হতে অস্তিত্বের কিনারে এসে পরমাণু হয় তা উঠে এসেছে গল্পের প্লট আর সাব প্লটে। গ্রামের মোড়ল, চেয়ারম্যান–মেম্বারদের তথাকথিত শাসন আর চাপিয়ে দেয়া ফতোয়ার প্রসঙ্গ ক্লাইমেক্সের অনুসঙ্গ হয়েছে কাহিনীর মাঝামাঝিতে।
ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির সিনে হলে ‘মেঘনা কন্যা’র প্রদর্শনী দেখছিলাম পাশেই ছিলেন বাংলাদেশের লিজেন্ড অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। কাছাকাছি বসে অন্যদের সঙ্গে সিমেনাটি দেখছিলেন পরিচালক ফুয়াদ চৌধুরী। শো শেষ হতেই কথা হয় দু’জনের সঙ্গে। কথাবার্তায় বলছিলেন দীপ্ত টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফুয়াদ চৌধুরী। ২০০৩ সাল থেকে তাঁর মাথায় ঘটনাটি কিভাবে পাক খাচ্ছিল।
গাজীপুরে ডকুমেন্টারি বানাতে গিয়ে একটি ভদ্র পরিবারের সন্ধান পান তিনি। স্বামী–স্ত্রী মিলেমিশে গ্রামের মানুষের সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিল। মধুর ব্যবহার করে কিশোরীদের বিক্রি করে দিতো–অথচ কেউ তা জানতো না। ব্যাপারটি জানাজানি হলে ওই পরিবারটিকে আর খুঁজে পায় না কেউ। সেই গল্পের সিনে রূপ ‘মেঘনা কন্যা’। পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলছিলেন, দু–একটি জায়গায় অভিনয়ের অপরিপূর্ণতা লক্ষ্যণীয়। তবে সময়ের প্রয়োজনে এ সিনেমা বাজিমাতের দাবি রাখে।
নির্মাতার গল্পে অবশ্য উঠে এসেছে গ্রাম–শহরের ভেদাভেদ আর চোখ খুলে দেয়ার মর্মবাণী। চিত্রকল্প হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন নদীপারের সুনিবিড় গ্রাম। যার চারপাশ ঘেরা মেঘনা নদী। মাঝখানে কলার মোচার মতো ভেসে থাকে উলানিয়া। শহরের মেয়ে প্রজ্ঞা এসেছে সে গ্রামে। মনভাঙা মেঘ তার মনের গহীনে। চোখের তারায় মেজাজ হারানোর ঝিলিক।
গ্রাম তার একেবারেই ভালো লাগেনি। কদিন বাদেই ক্যাম্পাসে নাচের অনুষ্ঠান। সেখানে পারফর্ম করবে সে। মাঝখানে বাধ সাধে মৌলবাদী পরিবারে বেড়ে ওঠা বয়ফ্রেন্ড। ব্যাপারটা প্রজ্ঞার একেবারেই ভালো লাগেনি। আবহমান সংস্কৃতিকে সেই যুবক অবহেলা করেছে। নাচ গান অভিনয় সবই তার কাছে হারাম। আর এসব যারা করে তারাও খারাপ। বয়ফ্রেন্ডের এ মানসিকতার সঙ্গে একেবারেই বনেনি মেয়েটির।
সিনেমার শুরুতেই এ ব্যাপারগুলি ঘটে যায় মুহূর্তে। যেমনটি আজকাল হচ্ছে। গ্রাম–গঞ্জে গান বাজনা বন্ধপ্রায়। হাতের মুঠোয় মোবাইল ফোনে অশ্লীলতা ভরপুর। অথচ যাত্রাপালা, পুতুল নাচের মতো ঐতিহ্যবাহী ফর্ম একেবারেই বন্ধ। প্রশাসন ও সরকারদলীয় নেতারাও এসবে বাধা দিচ্ছে।
আরও পড়ুন: ঈদে মুক্তি পাচ্ছে ‘মেঘনা কন্যা’
লেটো গান, বিচার গান, মারফতি পালা, রামায়ণ–মহাভারত–মনসামঙ্গল সবই বন্ধ। একে একে শাট ডাউন সিনেমা হল। অথচ ছবি দেখতে গিয়ে একসঙ্গে হাসা, একসঙ্গে কাঁদা কিংবা অনুভূতির অনন্য প্রকাশ সিনেমা হলেই ছিল। দর্শকরা সেসব থেকে বঞ্চিত বহুদিন ধরে। এমন সব রাজনৈতিক আর মোল্লামির ট্যাবু ভাঙতে চেয়েছেন কাহিনীকার ফুয়াদ চৌধুরী। একইসঙ্গে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশব্যাপী বাউলদের ওপর যে নির্যাতন–অত্যাচার চলছে তা–ও তুলে ধরেছেন ফুয়াদের মস্তিষ্ক।
ক্লাইমেক্সের পারদ যখন উঠতে থাকে তখন গ্রামে ফিরে আসে হাসি। প্রজ্ঞা ছুটে যায় তার কাছে। গ্রামের মানুষগুলো প্রজ্ঞার মতো প্রগতির কথা চিন্তা না করেই দালাল নুরুল আর চেয়ারম্যানের চাপে খারাপ মেয়ে হিসেবে সাব্যস্ত করে। পতিতালয় থেকে পালিয়ে আসা হাসি আর তার বোন খুশিকে রাতের অন্ধকারে আবারও পাচার করতে চায় তারা। সত্যিকারের বাধা হয়ে আসে প্রজ্ঞা। তার সঙ্গী হয় আদিল। উত্তেজনা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে বেশ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু, ইয়ামিন হক ববি, শতাব্দী ওয়াদুদ, জয়শ্রী কর জয়া, নওশাবা, মোহাম্মদ বারী, সানজিদা মিলা, সেমন্তি দাস সৌমি, সাজ্জাদ হোসেইন, উপমাসহ অনেকে।
কলকাতার সোনাগাছি কিংবা শোভাবাজারের চৌহদ্দিতে বিক্রি হওয়া মেয়েদের চিত্রকল্পই মেঘনা কন্যার প্রতিপাদ্য। বিদেশে যাবার নাম করে সেখানকার কথিত মাসীদের জিম্মায় আটকে থাকা জীবনপাঁচালির নাম ‘মেঘনা কন্যা।’
সরদারনীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বিশিষ্ট মঞ্চ অভিনেত্রী জয়শ্রী কর জয়া। নিপাট অভিনয়ে তিনি শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন যাতে এমনিতেই জমে উঠেছে গল্পের আধেয়। সবমিলে এ কাহিনী চৌষিট্টি জেলার অগুণতি গ্রামের নাম না জানা পরিবারের। যাতে উপস্থিত সময়োপযোগী বার্তা। দর্শক অবশ্যই মুগ্ধ হবেন চিত্রকল্পের বাহার দেখে। গানের সুরে হবেন মোহিত। তার চেয়েও সচেতন হবেন সাধারণ মানুষ।
ডকুফিকশনের কাজ করতে গিয়ে গাজীপুরে যে গল্পের মুখোমুখি হয়েছিলেন ফুয়াদ চৌধুরী, চলচ্চিত্র ছাড়া তার পূ্র্ণ রূপ দেয়া সম্ভব ছিল না। ‘মেঘনা কন্যা’র মধ্য দিয়ে তার পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে। নারী পাচারের মতো কঠিন বিষয়কে সরলভাবে দর্শকের সামনে উপস্থিত করেছেন তিনি।
অখিল পোদ্দার/এজে/ দীপ্ত সংবাদ