প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘সুখবর বাংলাদেশ’ বইটি যেন এক চলমান সময়ের দলিল। এখানে ঠাঁই পেয়েছে বাংলাদেশের সেই সব অদম্য মানুষের গল্প, যারা নিজেদের ইচ্ছা আর পরিশ্রমে শুধু নিজের নয়, বদলে দিয়েছেন দেশের ভাগ্যও। এই বইয়ের পাতায় তেমনই এক উজ্জ্বল নাম মিনহাজ উদ্দীন, যিনি কওমি মাদ্রাসা‘র ৪ দেয়াল থেকে বেরিয়ে তথ্য–প্রযুক্তির বিশাল জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং এখন শত শত তরুণের জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছেন।
গল্প: সংগ্রাম ও উত্তরণ—
জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার এক ভূমিহীন কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করে মিনহাজ। শৈশব থেকেই বেড়ে উঠেছেন শেরপুরে। পরিবারের ইচ্ছায় তিনি কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং ২০১০ সালে কোরআনে হাফেজ ও ২০১৭ সালে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। তবে তার জ্ঞানার্জনের পিপাসা শুধু মাদ্রাসার গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তিনি শেরপুর সরকারি কলেজ থেকে ইসলামি শিক্ষায় স্নাতক এবং ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও অর্জন করেন।
২০১৭ সালে মিনহাজের জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তথ্য–প্রযুক্তিভিত্তিক একটি পেশাবিষয়ক আয়োজনে অংশ নিয়ে তিনি ফ্রিল্যান্সিং জগতের সঙ্গে পরিচিত হন। এরপর সরকারি এলআইসিটি প্রকল্প থেকে ‘সফট স্কিল ও গ্রাফিকস’ বিষয়ে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ নেন। অসচ্ছল পরিবারের হাল ধরতে ছাত্র পড়ানোর পাশাপাশি এই প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাওয়া ছিল এক কঠিন সংগ্রাম। ধারদেনা করে সংসার চললেও নিজ লক্ষ্য থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি মিনহাজ।
সাফল্যের আলোয়—
প্রশিক্ষণের ফল পেতে দেরি হয়নি। কোর্স শেষ হওয়ার আগেই একটি বেসরকারি সংস্থায় ২০ হাজার টাকা বেতনে চাকরিতে যোগ দেন মিনহাজ। তবে তার স্বপ্ন ছিল আরও বড়। ২০১৭ সালের শেষ দিকে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট দিয়ে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেন। শেরপুর বসেই বিদেশি গ্রাহকদের কাজ করে তিনি এখন মাসে প্রায় দেড় হাজার মার্কিন ডলার আয় করেন। পাশাপাশি দূর থেকে অস্ট্রেলিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানেও চাকরি করছেন।
নিজ উপার্জনে তিনি পরিবারে এনেছেন সচ্ছলতা। ভূমিহীন বাবার জন্য জমি কিনেছেন, বোনের পড়াশোনা ও বিয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন এবং নিজের জীবনের বড় স্বপ্ন—পবিত্র হজ পালন করেছেন।
অন্যের জন্য নিবেদিত প্রাণ—
মিনহাজ কেবল নিজ সাফল্যে সন্তুষ্ট থাকেননি। তিনি চেয়েছেন, তার মতো হাজারো মাদ্রাসা শিক্ষার্থী যেন শুধু মসজিদ–মাদ্রাসার অনুদানের উপর নির্ভরশীল না থেকে আত্মনির্ভরশীল হতে পারে। এই মহৎ উদ্দেশ্য তিনি ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আইটি টাচ ইন কওমি মাদ্রাসা’।
নিজের কেনা মোটরবাই চড়ে তিনি বিভিন্ন মাদ্রাসায় ছুটে যান প্রশিক্ষণের জন্য। এ পর্যন্ত প্রায় ৭০০ ছাত্রকে তিনি বিনামূল্যে কম্পিউটার ও ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তার এই উদ্যোগ বৃথা যায়নি। প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের মধ্যে ৩০ জন এখন নিয়মিত ফ্রিল্যান্সিং করছেন এবং প্রায় ৫০ জন কম্পিউটার বিক্রয়কেন্দ্র বা ই–কমার্স সাইট পরিচালনার মতো উদ্যোগে সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন।
তার এই অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিও মিলেছে। ২০২১ সালে তিনি শেরপুর ‘জেলা প্রশাসক উদ্যোক্তা পুরস্কার’ এবং আইসিটি বিভাগ থেকে ৩ লাখ টাকা অনুদান লাভ করেন। সেই অর্থ দিয়ে তিনি জামিয়া সিদ্দিকীয়া মাদ্রাসায় ১০টি কম্পিউটার নিয়ে একটি আধুনিক ল্যাব তৈরি করে দিয়েছেন।
মিনহাজ উদ্দীন বলেন, ‘সুযোগ পেলে সারা দেশে কওমি মাদ্রাসা ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের দক্ষ করে তুলতে চাই।’
রাহিতুল ইসলামের লেখা ‘সুখবর বাংলাদেশ’ বইটি মিনহাজের মতোই প্রযুক্তি, প্রতিভা আর প্রত্যয়ের গল্প বলে। নিয়াজ চৌধুরী তুলির প্রচ্ছদে ৩৫০ টাকা মূল্যের বইটি দেশের ইতিবাচক পরিবর্তনের এক জীবন্ত চিত্র, যা প্রতিটি পাঠককে নতুন সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখাবে।
বইটি প্রথমা প্রকাশনের সকল আউটলেট, দেশের প্রধান বইয়ের দোকান এবং অনলাইন বুকশপ প্রথমা ডটকম ও রকমারি ডটকমে পাওয়া যাচ্ছে।
মাসউদ/এসএ